(ফিল্ম রিভিউঃ অনুব্রত ভাল আছো)
স্বরূপ গোস্বামী
নামটা কার দেওয়া চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্তর নাকি পরিচালক পার্থ সেনের ? যাঁর মাথা থেকেই বেরোক, আসল চমকটা যেন সেখানেই।
অনুব্রত বেশ স্বনামধন্য। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বীরভূমের কয়েকজন মানুষের নাম জিজ্ঞেস করুন। রবি ঠাকুর বা অমর্ত্য সেনের নাম কজন বলবেন, সন্দেহ আছে। তার থেকে অনেক বেশি লোক বলবেন শ্রীমান অনু্ব্রত মণ্ডলের নাম। কখনও তিনি পুলিশের গাড়িতে বোম মারতে বলেন। কখনও কব্জি কেটে নেওয়ার কথা বলেন। কখনও শোনা যায়, তাঁর মাথায় নাকি অক্সিজেন যায় না। পুলিশের খাতায় ফেরার হলেও মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্য পুলিশের ডিজির সঙ্গেই দিব্যি এক মঞ্চে থাকেন। তিনি কোর্টে হাজির হলে পুলিশ সাদরে চেয়ার এগিয়ে দেয়, পাখাটা তাঁর দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তাঁর বিরুদ্ধে হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট, নানা রকম মামলা হয়। উঠেও যায়। যাঁরা মামলা করেন, সেই হৃদয় ঘোষরাই তাঁর আশীর্বাদের হাত মাথায় ছোঁয়ানোর জন্য ব্যাকূল। সবমিলিয়ে এই অনুব্রত ভালই আছেন।
কিন্তু সিনেমার অনুব্রত! সেখানে যেন দুখের করুণ রাগিনী। স্ত্রী অসুস্থ। লড়াই করছেন মৃত্যুর সঙ্গে। গালে অনেকদিনের না কাটা দাঁড়ি। রোজ সকালে চলে আসেন হাসপাতালে। সকালে এক ঘণ্টার ভিজিটিং আওয়ার। বিকেলে আরেক দফা। মাঝের সময়টুকু কোথায় আর যাবেন! ওই হাসপাতালেই কাটিয়ে দেন। এই রুটিন, এই রোজনামচায় যেন অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন পঞ্চাশ পেরিয়ে আসা অনুিব্রত। চারপাশে মাছির একটা অদ্ভুত আওয়াজ। সেই মাছি তিনি ছাড়া কেউ দেখতে পান না।
ছবিটা আগেই তৈরি হয়ে গেছে। দেশ বিদেশে নানা পুরস্কারও পেয়েছে। পুরস্কার পাওয়ার মতোই ছবি বানিয়েছেন পার্থ সেন। এই সব ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য হয়ত আনে না। তবে যে মার্জিত রুচির লোকেরা দেখেন, সেখানে শিল্পবোধের একটা কদর থেকে যায়। অনুব্রতর চরিত্রে কাকে নেওয়া যেতে পারত! টলিউডের পরিচিত মুখগুলো একবার ভাবার চেষ্টা করলাম। না, ঋত্বিক চক্রবর্তী ছাড়া অন্য কারও কথা বোধ হয় ভাবাই যেত না। এত সুন্দরভাবে ছোট ছোট অনুভূতিগুলোকে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতেন বলে মনেও হয় না। গ্লামার বা স্টারডাম নেই, কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই, অভিনয়ের নিরিখে এই মুহূর্তে তিনিই টলিউডের সেরা বাজি।
ঋত্বিকের অসুস্থ স্ত্রী হিসেবে দেবলীনা যেন নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যাঁরা সিরিয়ালের লঘু চরিত্র আর সস্তা সংলাপে দেবলীনা দত্তকে দেখতে অভ্যস্থ, তাঁরা এই ছবিটা দেখতে পারেন। একেবারে অন্য এক দেবলীনাকে খুঁজে পাবেন। তেমন সংলাপ নেই। এম সি ইউ বা লং শটও তেমন নেই। ক্লোজ আপে শুধু মুখের অভিব্যক্তিই অনেক বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। অমিতাভ দাশগুপ্তর কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘আমার নীরবতা আমার ভাষা।’
অসহায় চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকা। হয়ত মৃত্যুর দিন গোনা। মৃত্যু আসছে জেনেও মানতে পারা- না পারার দোলাচল। আপাত করুন এই দৃশ্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছেন ঋত্বিক। অদ্ভুত একটা বাঁক এল বিরতির সময়। স্বামী অসুস্থ। রোজ হাসপাতালে আসছেন জয়া। একটু চোখাচোখি, একটু সহমর্মিতা। আস্তে আস্তে দুটো সহমর্মী মনের জড়িয়ে যাওয়া। হয়ত একে অন্যের মাঝে কিছুটা নির্ভরতা খোঁজা। এই জয়ার চরিত্রে স্বস্তিকা মুখার্জি একটা বড় চমক। গ্ল্যামারাস সুন্দরী নায়িকাকে যদি পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া শাশুড়ি হয়ে যাওয়া মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতে হয়, চমক তো থাকবেই। অন্য কোনও হিরোইন এই চরিত্রে কাজ করতে রাজি হতেন ? জানি না। তবে এখানে স্বস্তিকাকে এতটুকু বেমানান লাগেনি। সুন্দর মেক আপ যেমন চরিত্রটাকে বিশ্বাসযোগ্য করেছে, তেমনি বাকিটুকু করেছে স্বস্তিকার অভিনয়।
কখনও অসহায় স্ত্রী, কখনও ঋত্বিকের হয়ে ওঠা ভাল বন্ধু। বন্ধু থেকে অর্ধপ্রেমিকা। আবার মেয়ে জামাইয়ের কাছে সেই সম্পর্ক লুকোনোর একটা চেষ্টা। জড়তা, সংকোচ, পিছুটান। সব মিলিয়ে এই চরিত্রেও নানা শেডস।
মৃত্যুর চিত্রনাট্যে জীবনের উকিঝুকি। হাসপাতালের একঘেয়ে অপেক্ষার মাঝে এসে পড়া অন্য এক রোমাঞ্চ। স্বাভাবিক নিয়মেই পরিণতিহীন সম্পর্কের থমকে যাওয়া। এমন মুহূর্ত বাংলা ছবিতে আগে সেভাবে দেখা যায়নি। একেবারে অন্য এক ভাবনা বয়ে আনতে চেয়েছেন পরিচালক পার্থ সেন। ছোট্ট অথচ মজাদার চরিত্রে খরাজ মুখার্জিও নিজের ছাপ রেখে গেছেন। চরিত্রটার সঙ্গে মূলস্রোত কাহিনীর তেমন সম্পর্ক নেই। আবার অপ্রাসঙ্গিক বা আরোপিত চরিত্রও মনে হবে না। একটা বড় অসঙ্গতি, গোটা সিনেমাজুড়ে বোঝার উপায় নেই, অনুব্রতর (ঋত্ত্বিকের) কাজটা কী ? মানে, পেশা কী ? সারাদিন হাসপাতালে পড়ে থাকা নিশ্চয় অফিস কাছারি থাকলে সম্ভব হত না। আবার কর্মহীন হলে চিকিৎসার ওই বিশাল ব্যয়ভার বহন করাও সম্ভব ছিল না। এই একটা জায়গায় চিত্রনাট্যে অস্পষ্টতা থেকেই গেছে।
তবে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে, অনুব্রত নামটা। এটাই বোধ হয় আসল মাস্টারস্ট্রোক। অনুব্রত কেমন আছে, সবাই জানতে চায়। অনুব্রত ভাল থাকলে, তাঁর মাথায় ঠিকঠাক অক্সিজেন গেলে, বীরভূম ভাল থাকবে।
বীরভূমের অনুব্রতবাবুর আবার এসব ছবিতে তেমন রুচি নেই। তিনি শোলেতে গব্বর সিংকে দেখেন, মিস্টার ইন্ডিয়ায় মোগাম্বোকে দেখেন। তাঁর নাকি ভিলেন দেখতেই ভাল লাগে। তবু কোনওভাবে তাঁকে এই ছবি দেখানো যায় না ? হয়ত ভাবতেন, তাঁর বায়োপিক। প্রিমিয়ারে যদি তাঁকে সবুজ কার্পেটে আমন্ত্রণ জানানো হত, কী ভালই না হত! চ্যানেলে চ্যানেলে কী প্রচার হত, একবার ভাবুন তো!
এই একটা জায়গায় মস্তবড় ভুল করে ফেললেন পরিচালক।