সুশোভন পাত্র, দিল্লি
অভিজিৎ রায়কে কি আমি চিনতাম ? বোধ হয় না। খুব অনুসরণ করেছি ? তেমনও বোধহয় না। তাঁর সব বই কি আমার পড়া ? কই না তো। শুধু “মুক্তমনার” লেখক হিসেবে একরকম করে চিনতাম। ‘মুক্তমনা’ তে তাঁর একাধিক লেখা পড়েছি। সমৃদ্ধ হয়েছি। গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো করার মতোই দূর থেকেই তাঁর লেখা পড়ে তাঁকে শ্রদ্ধা করেছি। তাঁর কলমকে কুর্নিশ করেছি। কিন্তু যা বুঝিনি তখন, আজ সেটা বুঝলাম।
বুঝলাম যে অভিজিৎ রায়ের লেখার ধার তাঁকে কোপানো মারণাস্ত্রের থেকে ঢের গুন বেশি। অভিজিৎ রায়ের লেখার গভীরতা মৌলবাদীরা তাঁকে কুপিয় যাওয়া রাতের অন্ধকারের চেয়ে লক্ষ গুন গভীর।অভিজিৎ রায়ের লেখার ব্যাপ্তি রক্তস্নাত বাঙলাদেশের বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে ভাষা শহীদের বেদীর থেকেও কয়েক যোজন বেশি বিস্তৃত । আর ধর্মীয় গোঁড়ামি, অনুশাসন এমনকি রীতি-রেওয়াজ থেকেও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তা যদি নাই হত , তাহলে কেনই বা অভিজিৎ রায়কে মরতে হল?
থাক না বিতর্ক। থাক না তক্কো। কীসের এত আপত্তি ? কোন আদর্শ, কোন মতবাদ, কোন লড়াই, কোন জেহাদ, কোন দাবী, কোন যুক্তি, কোন ধর্মাচরণের পরিধি আর ব্যাপ্তি দিয়ে এই রক্তবন্যা কে ব্যাখ্যা করবেন বলুন দেখি ? এই যে আপনারা, যারা কথায় কথায় ইসলাম কপচান, শরিয়ত্পন্থী রাষ্ট্র করে তুলতে চান, আজ একে হুমকি দেন, কাল ওকে গালিগালাজ করেন, রাতের অন্ধকারে কুপিয়ে খুন করেন, রক্তের হোলি খেলেন, প্রতিদিন, প্রতিপদে বাংলাদেশকে ঠেলে দিচ্ছেন নিশ্চিন্ত অন্ধকারের দিকে, ধ্বংসের দিকে, আপনাদের বলছি , এপারে থেকেও ওপারকে আমরাও ভালবাসি, খবর রাখি, আপন মনে করি, আর তাই দুশ্চিন্তা হয়। যে সিনেমা- ছবি- বই- নাটকে- কার্টুন আপনার “নাজুক” ভাবাবেগে আঘাত লাগছে, কোনও অন্ধ বিশ্বাসের স্ক্রু হালকা করে আলগা হয়ে যাচ্ছে, আপনার ধর্মাচরণ যুক্তির কাছে ক্যাবলা হয়ে যাচ্ছে, চোখের ঠুলি খুলে রাখার আস্কিং রেট বাড়ছে দয়া করে সেগুলিকে এড়িয়ে চলুন। ভাল না লাগলে মকবুল ফিদা হুসেনের সরস্বতীকে পূজা করবেন না, তসলিমা নাসরিনের বই কিনবেন না, সলমন রুশদি পড়বেন না, শারলি এবেদো চাখবেন না, পপকর্ন চিবিয়ে পিকে বা ওহ্ মাই গডের কর্নার সিটের টিকিট করবেন না। আপনি যে আজান পড়েন তা আমার কুরুচিকর মনে হতে পারে, যে হনুমান চল্লিশা গান শোনেন তা আমার পছন্দ নাই হতে পারে এবং সেই গান লোকে শোনে ভাবলে সমাজ কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে গোছের চিন্তায় আমার রাতে ঘুম না আসতেই পারে। কিন্তু যতক্ষণ না সেই গান চালিয়ে আপনি আমার জীবন অতিষ্ঠ করছেন, ততক্ষণ আপনার সেই গান শোনায় হস্তক্ষেপ করার পক্ষে যুক্তি আছে কি ? কারণ আপনার যা ঘোর অপছন্দের, তা হয়তো আর এক জনের কাছে বেঁচে থাকার মন্ত্র। তাই কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকাটা যেমন আপানদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, নিজেকে মুক্তমনা করা আমাদেরও ব্যক্তিস্বাধীনতা। সে বিষয়ে লেখা, কথা বলা আমাদেরও বাকস্বাধীনতা।
জানি বাকস্বাধীনতা জিনিসটা কিন্তু নিখরচায় মেলে না। বহু ক্ষেত্রেই তার মূল্য চোকাতে হয়। অভিজিৎ রায়ই কেমন দূরদর্শী ছিলেন দেখুন। সেই কবেই ফেসবুকের দেওয়াল ভরিয়ে গেছেন, লিখে … “যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি..” ঐ যে কথায় বলে Pen is mightier than sword ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতায় পড়েছিলাম, ‘চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’ সেই কবিতার রেশ ধরেই বলতে ইচ্ছে করছে, অভিজিত রায়ের মৃত্যু আমাকে বড্ড অসহায় করে দেয়। আসলে লিখতে গেলে পড়তে হয়। পড়তে গিয়ে জানতে হয়। শিখতে হয়। ভাবতে হয়। ভাবা প্র্যাকটিস করতে হয়। আর সেই পথের অভিজ্ঞ শরিক কমরেড আজ শহীদ।
আমার অসহায়তা কি অন্যায় ? আপনিই বলুন ?