সরল বিশ্বাস
অটল বিহারী বাজপেয়ী তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তখন তের মাসের সরকার। মূলত শরিকদের সমর্থনের উপরেই নির্ভরশীল। তবু ঠিক দুর্বল সরকার বলা যাবে না। একটা ভাল স্লোগান বের হল, পার্টি উইথ ডিফারেন্স। অর্থাৎ, অন্য ধরনের দল।
তখন রাজনীতিতে এভাবে কর্পোরেটদের আবির্ভাব হয়নি। ফেসবুক, টুইটার নামের শব্দগুলো তখনও কেউ শোনেননি। দলের নেতারাই মাথা খাটিয়ে বের করেছিলেন স্লোগানটা। অনেকের মনেই দাগ কেটেছিল। এমন একটা দল, যারা ভারতীয় সভ্যতা ও পরম্পরায় বিশ্বাস করে। এমন একটা দল, যারা বয়স্কদের বা গুণী মানুষদের সম্মান করে।
তখন যত না সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, প্রায় তার দ্বিগুন আসন নিয়ে আজ ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। কোনও শরিক নির্ভরতা নয়, একার চেষ্টাতেই সরকার গড়ার ক্ষমতা রাখে বিজেপি। সরকারের উপর, দলের উপর অনেক বেশি কর্তৃত্ব নরেন্দ্র মোদির। সবথেকে বেশি উপেক্ষিত ও অসম্মানিত কারা ? তাঁর দলের প্রবীণরাই।
দলের বর্ষীয়াণদের আগেই কার্যত বানপ্রস্থে পাঠিয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। যে রাজ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী, সেই রাজ্য থেকেই সর্বভারতীয় সভাপতি। যে মানুষটা দেড় বছর আগে বিজেপি-র প্রথম পঞ্চাশ জন নেতার মধ্যেও ছিলেন না, তিনি হঠাৎ দলের শীর্ষে। বিজেপি-র মতো একটা শৃঙ্খলাপরায়ন দলে এমনটা ভাবাই যায় না।
তবু মনে হয়েছিল, অমিত শাহ হয়ত সংগঠনটা বোঝেন। মনে হয়েছিল, তিনি অন্তত প্রবীণদের সম্মানটুকু দেবেন। দেখা গেল ঠিক উল্টো ছবিটা। নইলে, জরুরি অবস্থার ৪০ বছর পূর্তিতে লালকষ্ণ আদবানিকে এভাবে উপেক্ষিত থাকতে হয়! অমিত শাহরা হঠাৎ করে নেতা হয়ে গেছেন। দেশের ইতিহাস, পরম্পরা কোনওটাই তেমন জানেন বলে মনে হয় না। জানলে, এভাবে আদবানিকে উপেক্ষা করতে পারতেন না।
জরুরি অবস্থার পরে মোরারজি দেশাই সরকারে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হয়েছিলেন আদবানি। একটি স্মরণীয় উক্তি করেছিলেন মিডিয়ার উদ্দেশ্যে। বলেছিলেন, ‘জরুরি অবস্থায় আপনাদের একটু নত হতে বলা হয়েছিল। আপনারা নতজানু হয়ে গিয়েছিলেন।’ কথাটা আজ প্রায় প্রবাদের চেহারা নিয়েছে।
এখন দলীয় নেতাদের অসহায় আত্মসমর্পন দেখেও হয়ত মনে মনে একই কথা বলছেন। যে মানুষটা জরুরি অবস্থায় দেড় বছরের বেশি সময় জেলের ভেতর ছিলেন, দলীয় অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা হবে না ? জরুরি অবস্থার যাঁরা শিকার, তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হল। সেই তালিকায় একেবারে সামনের সারির নামটাই তো হওয়া উচিত লালকৃষ্ণ আদবানি। জরুরি অবস্থায় যাঁরা লড়াই করেছেন, সেই জয়প্রকাশ নারায়ন, মোরারজি দেশাইদের কথা বললেন নরেন্দ্র মোদি। নিজের দলের আদবানির কথা মনে পড়ল না ?
দলকে কোনদিকে নিয়ে যেতে চাইছেন মোদি-অমিত শাহরা ? দেশকেই বা কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছেন ? একজন প্রবীণ মানুষকে ন্যূনতম সম্মান জানাতে এত কার্পণ্য কেন ? জরুরি অবস্থায় কে চিনত অমিত শাহকে। এই দিনে কে তাঁর ওই ভাষণ শুনতে চায়! আদবানি থাকতে তিনি মুখ্য বক্তা! ভারতীয় পরম্পরা অনেক বড় কথা। আগে নিজের দলের ইতিহাসটা শিখুন।
দেশের মানুষ অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এনেছিল বিজেপি-কে। সেই প্রত্যাশার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি ‘আচ্ছে দিন’এর সরকার। দলীয় কর্মীদেরও প্রত্যাশা ছিল, দলে হয়ত অন্য একটা কাঠামো তৈরি হবে। কিন্তু অমিত শাহদের হাতে দলও হতাশই করছে। ‘অন্য রকম দল’ আর থাকছে কোথায় ? রাজনাথ সিং নামে একজন ছিলেন সর্বভারতীয় সভাপতি। সংগঠন ছেড়ে তিনি মন্ত্রী হওয়ার লোভ সামলাতে পারলেন না। এখন মোদি ঢুকলে তাঁকে নতজানু হয়ে উঠে দাঁড়াতে হয়। এমনকি দলের সভাতেও উঠে দাঁড়াতে হয় চেয়ার ছেড়ে।
আজ আদবানিকে ব্রাত্য রাখায় সেই রাজনাথরাও বড়ই নীরব। তাঁদের দেখেই হয়ত জরুরি অবস্থার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে প্রবীণ নেতার। মনে মনে হয়ত বলছেন, নত হতে বলা হয়েছিল। তোমরা এখনও সেই নতজানুই থেকে গেলে।