(আই এস এল প্রায় শেষ পর্যায়ে। কতটা দাগ কাটছে এই আই এস এল ? মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলকে ঘিরে যে আবেগ, তাতে কি ভাটা পড়তে পারে ? গত বছর আই এস এল চলাকালীন দারুণ একটি লেখা লিখেছিলেন ময়ূখ নস্কর। সেই লেখাটি এখনও বেশ প্রাসঙ্গিক। তাই পাঠকদের অনুরোধে তা আবার ছাপা হল। )
দেল পিয়েরোকে সোলডার চার্জ করছেন মেহরাজউদ্দিন। মার্কো মাতেরাজ্জির বদলে মাঠে নামছেন জেজে। শৌভিক ঘোষকে টপকাতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একসা হচ্ছে ত্রেজেগুয়ে- দেখেশুনে কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়।
স্বপ্ন আমার একটা ছিল বটে। ভারত একদিন বিশ্বকাপে খেলবে। জিতবে। গোটা শৈশব আর কৈশোর জুড়ে আমি এই স্বপ্ন দেখেছি। আমার স্কুলজীবনের খাতাগুলো যদি আজ খুঁজে পাওয়া যেত, দেখা যেত তাতে অজস্র জার্সির ডিজাইন। বিশ্বজয়ী ভারতের জার্সি কেমন হবে, সে দেখভালের দায়িত্ব তো আমারই ছিল। ভারতের নীল জার্সির মতোই রঙ, শুধু এই কারণেই ইতালির সমর্থক হয়েছিলাম। শুধু এই কারণেই আমার খাতায় খাতায় ছিল রবার্তো বাজ্জো আর পাওলো মালদিনির ছবি।
সেদিন কে জানত, বাজ্জো-মালদিনিও একদিন বুড়ো হবে, অবসর নেবে। ফিকে হয়ে আসবে স্বপ্নের নীল রঙগুলো। কে জানতো বয়স হলে সারা দুনিয়াটাই রঙ হারিয়ে ফেলে! নিজের দেখা স্বপ্নগুলোকেও তখন বাস্তবের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হয়। নিজের ছেলেমানুষির কথা ভেবে নিজেকেই হাসতে হয়। তবুও শৈশবের তো কখনও মৃত্যু হয় না। পূর্বজন্মের স্মৃতির মতো কোনও রত্মপেটিকায় সঞ্চিত থাকে সেইসব দিন। আজও যতবারই বিশ্বকাপ দেখতে টিভির সামনে বসি, ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে আসে স্কুলের খাতার হলদেটে হয়ে আসা পাতাগুলো। অপটু হাতের আঁকা ছবিগুলো গুনগুন করে বলে, ‘হবে, নিশ্চয় হবে। একদিন তোমার দেশ নিশ্চয় বিশ্বকাপে খেলবে। তুমি না দেখলেও তোমার সন্তান সে দৃশ্য দেখবেই।’
বেশ, বেশ। আমার ছেলে দেখলেই হবে। আমি না হয় আই লিগ দেখেই জীবন কাটিয়ে দেব।’- বলে টিভির পর্দায় মন দিই। আর ভাবি ভারত বিশ্বকাপে সুযোগ পেলে একদিনের জন্য একটা মিস্টির দোকান বুক করে ফেলব বলে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তার কী হবে?
সহসা চমক ভাঙে রহিম নবির পাশে আনেলকাকে দেখে। দেখি শিলটন পাল উদ্ধত তর্জনি নাড়ে রবার্ট পিরেসের দিকে। অর্ধেক হৃদয় প্রবল উচ্ছ্বাসে বলে, ‘এটাই ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ হে। চলো চলো দেখে আসি। মহান জিকোর দল শুভাশিস রায়চৌধুরিকে গোল দিতে পারে কিনা। দেখে আসি কলকাতার দলকে কোন পরামর্শ দেয় দিয়েগো সিমিওনে।’
তখনই বাকি অর্ধেক হৃদয় করুণ স্বরে বলে, ‘ভবিষ্যৎ যখন এসেই গেছে, তখন আর কটা দিন না হয় অতীতকে জড়িয়ে থাকো। তোমার অতীতে তো শুধু বিশ্বকাপ ছিল না। ছিল কাঠের তক্তা দিয়ে ঘেরা মোহনবাগান মাঠ। ছিল লম্বা লম্বা ঘাসের নিচে থসথসে কাদার মধ্যে আঁকাবাঁকা লাইন। ছিল তক্তার ফাঁকে গর্তের মতো টিকিট কাউন্টার। এগারোটা সবুজ মেরুন জার্সি মাঠে নামছে। ভাগীরথীর বৈকালিক হাওয়ায় ভাসছে অভিধান বহির্ভূত হো হো শব্দ। যেন ধ্রুপদের সুর। আই এস এলের মাঠে কি ওই সুর শুনতে পাবে? ইঁদুর কি কখনও ওই মাঠে যাবে?
আমাদের গ্রামের ছেলে ইঁদুর। ভাল নাম বোধহয় জয়দেব। খেলা মানেই তার কাছে ফুটবল। আর ফুটবল মানে মোহনবাগান। নিজে কানাকড়িও খেলতে পারত না। কিন্তু মোহনবাগানের কোন খেলোয়াড় কত নম্বরের জার্সি পরে খেলে, তা নির্ভুল বলে দিতে পারত। মোহনবাগানের কোনও খেলোয়াড় মাঠে পড়ে গেলে তাকে নিজের পায়ে হাত বোলাতে দেখেছি। ফলতা থেকে মোহনবাগান মাঠে আসতে হলে ৮৩ নম্বর বাসে চড়তে হয়। বাসভাড়া দিতে পারবে না বলে ইঁদুর ড্রাইভার কন্ডাক্টরদের সঙ্গে অভিনব চুক্তি করেছিল। দুপুরের প্রায় খালি বাসে উঠে সে কন্ডাক্টর-ড্রাইভারদের হাত পা দলাই মলাই করতে করতে বাবুঘাটে আসত।
ইঁদুরের বাবা ছিলেন আরেক কাঠি সরেস। তিনি ঝাঁকাভর্তি সবজি নিয়ে বিক্রি করতে যেতেন সহরার হাটে। পরিচিত, অপরিচিত কেউ যদি হেঁকে বলত, খেলা দেখতে যাবে গো খুড়ো? তিনি সবজি সমেত ঝাঁকা হাটের মাঝে কিম্বা পথের ধারে ফেলে ছুটতেন তার পিছু পিছু। একবার তিনি হাট থেকে ফিরছেন। মাথার ঝাঁকায় রাখা ট্রানজিস্টারে শোনা যাচ্ছে মোহনবাগানের খেলার রিলে। রিলে শোনার জন্য দিন কয়েক আগে ট্রানজিস্টারটা কেনা হয়েছে। অনেক কষ্টের টাকায়। কিন্তু খেলার অন্তিম লগ্নে মোহনবাগান যেই গোল খেল, তিনি ট্রানজিস্টারটাকে অপয়া বিবেচনা করে মারলেন এক আছাড়। সেখানেই ট্রানজিস্টারটির মৃত্যু হল।
এমনই সব চরিত্র দেখেছি টালিগঞ্জের এক বাজারে। কোনও এক সবজিওয়ালা টমেটো আর কুমড়ো পাশাপাশি রাখত না। ইস্টবেঙ্গলে পতাকার মতো দেখতে হবে বলে। কোনও এক ওষুধের দোকানদার ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে মোহনবাগানিদের ওষুধ বিক্রি করত না। আবার কোনও এক মাছওয়ালা মোহনবাগান জিতলে স্পেশাল ছাড় দিত।
ওই বাজারেই পটলাদার বইয়ের দোকান। দোকানের শো-কেসে একটিই বই- ‘ক্লাবের নাম ইস্টবেঙ্গল।’ তলায় লেখা ‘নট ফর সেল’। বই বিক্রি তো পটলার উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য সবাইকে জানান দেওয়া, সে কোন মহান ক্লাবের সমর্থক। একদিন পটলাদার বাবা আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, ‘শুনছস, ইস্টবেঙ্গল হারিসে। এবার পটলা দোকানে বসব।’
পটলাদার বাবার আনন্দের কারণ ছিল। ফুটবলের মরশুমে তাকে কোনওদিন দোকানে পাওয়া যেত না। হয় খেলা দেখতে, নয় প্র্যাকটিস দেখতে সে ময়দানে যেত।
তার ছিল এক অদ্ভুত কুসংস্কার। ইস্টবেঙ্গলের পেনাল্টি বক্সে যখন বল ঢুকবে, তখন গ্যালারিতে পটলাদার সামনে বসা লোকটি যদি নাড়াচাড়া করে, তাহলে গোল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমনই ছিল তার বিশ্বাস। একবার ইস্টবেঙ্গল হারল, আর পটলাদা মার খেয়ে বাড়ি ফিরল। কারণ সহজ, বিপক্ষ গোল দেওয়ার পর পটলা মহা রেগে সামনের নড়াচড়া করা ভদ্রলোকের মাথায় চাঁটি মেরেছিল। তারপর যা হয়ে থাকে! প্রবল গণপিটুনির মধ্যে পটলা কিছুতেই বোঝাতে পারেনি যে সে মোহনবাগানের সমর্থক নয়।
মাঠে গিয়ে হেনস্থা হতে হয়েছিল বুম্বাদাকেও। ডায়মন্ড সিস্টেমের বছরে ফেড কাপের সেই সেমিফাইনালে সে একদল ইস্টবেঙ্গল সমর্থক বন্ধুর সঙ্গে মিনিবাস ভাড়া করে মাঠে গিয়েছিল। ইচ্ছা ছিল, বাঙালদের দেখিয়ে দেখিয়ে নৃত্য করবে। কিন্তু হায়। ম্যাচের পর মিনিবাসের গরম ইঞ্জিনের উপরে বুম্বাদাকে বসিয়ে বন্ধুরা বলেছিল, ‘তোর মুখ তো পুড়েইছে। আয় পোঁদটাও পুড়িয়ে দিই।’
ফুটবল মাঠে যাবার কথা উঠলেই এই চরিত্রগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাপ্পার কথা। আমার পরম শত্রু ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার বাপ্পা। সেই অভিশপ্ত ফেড কাপ সেমিফাইনালের পর আমি যখন ঘরের কোনে মুখ লুকিয়ে বসে আছি, তখন সে এসে আমার পিঠে হাত রেখে বলেছিল, ‘চল, একটু খেলে আসি, মন ভাল হবে।’
মনে পড়ে মোহনবাগান মাঠের সেই নাম না জানা লোকটাকে, ‘দল জেতার পর সমবেত উল্লাসের মধ্যে সে একবারও হাততালি না দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ, তাঁর দুটি হাতই ছিল কবজি থেকে কাটা। মনে পড়ে আমার এক দূর সম্পর্কের দাদুর কথা। সত্তর বছর বয়সে জীবনে প্রথমবার মাঠে গিয়ে গ্যালারি থেকে রেফারিকে গালাগাল দিয়েছিলেন। তারপর ভয় পেয়েছিলেন টিভিতে মেয়ে জামাই গালাগালটা শুনতে পায়নি তো!
আর মনে পড়ে সেই মেয়েটাকে। একাধারে বাঙাল এবং ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার হওয়ায় যার আমার দু চোখের বিষ হওয়ার কথা ছিল, পরিবর্তে হল এক বিষমাখানো ছুরি। যা সারাজীবনের মতো আমার পাঁজরে বিঁধে রইল। কবিতা আর ফুটবল এই নিয়ে কেটেছে আমাদের দিন। ইশ্বর মানিনে। তাই মোহনবাগানের দিব্যি দিয়ে বলছি, তার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করতে আমি চাইনি। চেয়েছিলাম,
‘পাগলি তোমার সঙ্গে ১৯১১ জীবন কাটাব।
পাগলি তোমার সঙ্গে ৫-০ কাটাব জীবন।’
শেষ দিনটায় সে চোখে জল নিয়ে বলেছিল, ‘কথা দে, বড় ম্যাচের দিনগুলোতে আমার কথা তোর মনে পড়বে।’ কথা রেখেছি আমি। দলবদলের জল্পনা শুরু হওয়া থেকে মরশুম শেষে ট্রফি না পাওয়ার হতাশা- প্রতিটি দিন ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে টক্কর। প্রতিটি দিনই আমার বড় ম্যাচ। প্রতিটি দিনই তাকে মনে পড়া।
আজ আই এস এলের আকাশ রাঙানো আতসবাজি দেখে ভারতকে বিশ্বকাপে দেখার স্বপ্ন যখন অবাধ্য জোনাকির মতো আবার জ্বলে উঠছে, তখন অর্ধেক হৃদয় ভয়ে কাঁপে। এই আতসবাজির আলোয় আমার মোহনবাগান, আমার বড় ম্যাচ, আমার সব মনে পড়া হারিয়ে যাবে না তো? হেমন্তের রাতে যুবভারতী চত্ত্বরের দেবদারুগুলোর পাতায় পাতায় যেন কার চোখের জল জমে। কে যেন বলে, ‘যদি বড় ম্যাচ বলে কিছু আর না থাকে, তাহলে কি তুই –’
বাকি অর্ধেক হৃদয় ছুটে গিয়ে তাকে আশ্বাস দেয়। বলে, ‘দূর পাগলি, নীরেন চক্কোত্তির ওই কবিতাটা পড়িসনি,
ফুরোয় না তার কিছুই ফুরোয় না,
নটে গাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়োয় না।’
কবিরা কি কখনও মিথ্যা বলতে পারেন!