স্বরূপ গোস্বামী
আচ্ছা, কোন ফুটবলার অনূর্ধ্ব পনেরো, আর কেই বা অনূর্ধ্ব ১৭ ? আপনি বুঝবেন কী করে? কার সঠিক বয়স, আর কেই বা বয়স ভাঁড়িয়ে খেলছে, সেটাই বা আপনি বুঝবেন কী করে ?
সমস্যাটা শুধু এই কলকাতা বা এই বাংলার নয়, সারা বিশ্বের। তাহলে উপায় ? কীভাবে বোঝা যাবে, কার বয়স কত? সারা পৃথিবীই মেনে নিয়েছে এম আর আই পরীক্ষাকে। আর এই পাইলট স্টাডি সবার আগে কোথায় হয়েছিল? শুনলে হয়ত বিশ্বাস হবে না। উত্তরটা হল এই কলকাতায়। কার তত্ত্বাবধানে ? তিনি এক বঙ্গসন্তান।
এ এফ সিতে পাঁচ জনের একটা মেডিকেল টিম আছে। সেখান থেকে ভারতের একজনই আছেন। ফিফাতেও এলিট প্যানেল ইনস্ট্রাক্টর এই দেশ থেকে একজনই। তিনিও এক বঙ্গসন্তান।
ক্রিকেটের দুনিয়ায় বিপ্লব যদি আই পি এল হয়, তবে ফুটবলের বিপ্লব অবশ্যই আই এস এল। আই পি এলে তিনি আছেন পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে। আই এস এলের মেডিকেল টিমেও তিনি অপরিহার্য। কে ? তিনিও এক বঙ্গসন্তান।
ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থায় তো তিনি বহুদিন ধরেই আছেন। ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থাতেও তিনি। আই সি সি-র মেডিকেল টিমে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। ওয়ার্ল্ড ব্যাডমিন্টনেও পাঁচজনের মেডিকেল টিমে তিনি। তিনিও এক বঙ্গসন্তান।
কোনও কুইজে এই প্রশ্নগুলো আসতেই পারে। কজন বাঙালি এই উত্তরটা জানেন? নামটা জেনে রাখা ভাল। নিশীথরঞ্জন চৌধুরি। তাঁকে ঠিক সেলিব্রিটি বলা যায় না। বুদ্ধিজীবীদের মিছিলেও তাঁকে দেখা যায় না। বঙ্গভূষণ, বিভূষণ, ক্রীড়ারত্ন – কোনওকিছুর জন্যই তাঁর নাম কেউ কখনও ভাবে না (জানলে তো ভাববেন)। অথচ, যাঁরা ভাবার, তাঁরা ভাবেন। ভাবে ফিফা, ভাবে এএফসি, ভাবে আইসিসি। কতবার কত সম্মান এসেছে, নিজেও ঠিকঠাক মনে রাখতে পারবেন না।
স্পোর্টস মেডিসিনের উপর কাজটা শুরু হয়েছিল একেবারে ছোট পরিসরে। সালকিয়া ফ্রেন্ডস দিয়ে যাত্রা শুরু। সেটা ১৯৮৪। নিউট্রিশন থেকে ডায়েট, ফিজিক্যাল ট্রেনিং থেকে মোটিভেট করা, সবই শুরু হয়েছিল তিন দশক আগে। তারপর সেইল ফুটবল দল। সেখান থেকে এলেন মোহনবাগানে। জাতীয় ক্লাব ছাড়িয়ে এবার জাতীয় দল। বাইচুং, বিজয়ন, আনচেরিদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন বছর দশেক। এখন ঘনঘন চোট লেগেই থাকে। অথচ, নয়ের দশকে ছবিটা এমন ছিল না। চোটের জন্য বড় কোনও বড় ফুটবলার হারিয়ে গেলেন, এমন উদাহরণ নেই। বাইচুং, বিজয়নরাও বড়সড় কোনও চোটের মুখে পড়েননি। পড়লেও দ্রুত তা কাটিয়ে উঠেছেন। নীরবে থেকে গেছেন যে মানুষটি, তিনি এই ডাক্তারবাবু।
আম বাঙালি উদাসীন হলেও এসব খবর যাঁরা রাখার, তাঁরা রাখেন। এএফসি-র মেডিকেল কমিটিতে পাঁচজনের তিনি একজন। ফিফা র্যা ঙ্কিংয়ে আমরা যতই নিচের দিকে থাকি, এলিট প্যানেলে বেশ সম্মানের সঙ্গেই আছেন নীশীথরঞ্জন। এরই ফাঁকে অস্ট্রেলিয়া থেকে করে এসেছেন স্পোর্টস মেডিসিনের মাস্টার্স। যা এই ভূ-ভারতে আর কারও নেই।
দেশ থেকে যেমন ছড়িয়েছে বিদেশে, তেমনি এক খেলা থেকে অন্য খেলায়। সে ক্রিকেট হোক বা ব্যাডমিন্টন। এবারের আই এস এলের কথাই ধরুন। অ্যাটলেলিকো ডি কলকাতার ছ-সাত জন ফুটবলার চোট পেলেন। ডাক পড়ল এই বাঙালি ডাক্তারের। এই তো সেদিন, এল এক অনন্য স্বীকৃতি। সারা এশিয়ায় স্পোর্টস মেডিসিনের উপর যাঁদের গবেষণা ও কর্মকাণ্ড স্পোর্টস মেডিসিনের দুনিয়ায় বিপ্লব এনেছে, এমন পাঁচজনকে ‘গোল্ডেন স্টার’ পুরস্কারে সম্মানিত করল এএফসি। সেই পাঁচজনের একজন এই নিশীথরঞ্জন।
লিখতে গেলে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। কিন্তু মানুষটা আমাদের অজানাই থেকে যাবেন। ট্রাডিশনটা নতুন কিছু নয়। সত্যজিৎ রায় আগে অস্কার পেয়েছেন, পরে ভারতরত্ন হয়েছেন। মাদার টেরিসা বা অমর্ত্য সেনের ক্ষেত্রেও নোবেলপ্রাপ্তি আগে, তারপর ভারতরত্ন। স্পোর্টস মেডিসিনে অন্য দিগন্ত খুলে দেওয়া কৃতী ডাক্তারকে আগে সারা বিশ্ব চিনুক। আমরা না হয় তারপর চিনব।