ময়ূখ নস্কর
একটু ব্যক্তিগত কথা দিয়ে শুরু করি।
আমার বোন একটি মুসলিম ছেলেকে প্রেম করেই বিয়ে করেছে। আমি নিজে নাস্তিক হলেও জন্মেছি এক হিন্দু পরিবারে। ধর্মীয় গোঁড়ামি না থাকলেও আমার পরিবারে মহিলারা ধর্মাচারণ করে। আমার বোনও করে।
মুসলমানের ঘরে বউ হয়ে যাওয়ার পর সে আর তার স্বামী একটা অদ্ভুত সমঝোতা করেছে। পশ্চিমদিকের দেওয়ালের তাকে কাবা শরিফের ছবি, এবং পূব দিকের দেওয়ালের তাকে কালী ঠাকুরের ছবি রেখে তারা নিজের নিজের প্রার্থনা জানায়। কী প্রার্থনা জানায়, তা তারাই জানে। তবে নিশ্চয় ‘আমার ঘরে বিধর্মীদের প্রবেশ নিষেধ’—এমন প্রার্থনা জানায় না।
আচ্ছা, আপনাদের কী মনে হয় ? আমার বোন আর তার স্বামী অসভ্য ? বোকা ?
আমরা তো জানি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আরও সভ্য হয়, আরও বুদ্ধিমান হয়। আমাদের দেশও নিশ্চয় তাই হচ্ছে। কিন্তু দেশ যে পথে যাচ্ছে, তা তো আমার বোনের পথ নয়। তাহলে অসভ্য কে ?
ভারতবর্ষে এমন অনেক মন্দির আছে, যেখানে অন্য ধর্মের মানুষদের প্রবেশ নিষেধ। শুধু অন্য ধর্মের কেন ? হিন্দু, কিন্তু ছোট জাত, এমন মানুষেরাও অনেক মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে না। এখনও। এই একবিংশ শতাব্দীতেও। আমাদের আশা ছিল, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে একদিন এই ভেদবুদ্ধি লোপ পাবে। একদিন মুসলমানরাও জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে। একদিন হিন্দুরাও কাবা শরিফে প্রবেশ করতে পারবে। যে ইশ্বরের ঘরে সবার ঠাঁই হয় না, তিনি কীসের ইশ্বর ? আমরা নাস্তিকরা কখনই এমন দিবাস্বপ্ন দেখিনি যে দেশের সবাই নাস্তিক হয়ে যাবে। শুধু চেয়েছিলাম, সব ধর্ম সব ধর্মকে কাছে টেনে নিক।
তা তো হলই না। মন্দিরে-মসজিদে বিধর্মীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা তো উঠলই না। উল্টে নতুন করে সোমনাথের মন্দিরে অ-হিন্দুদের প্রবেশ আটকানোর কথা ভাবা হচ্ছে।
সোমনাথের মন্দির। যার কথা ভাবলেই সুলতান মামুদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, তিনি এই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। হয়ত সেই স্মৃতি থেকেই মন্দিরে বিধর্মীদের উপস্থিতি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আচ্ছা হিন্দুগণ, নরেন্দ্র মোদির ‘আচ্ছে দিন’ তো এসে গেছে। ভারত কি এখনও এতটাই দুর্বল যে, ভক্তের বেশে ঢোকা জঙ্গিদের ঠেকানো যাবে না ? দেশে নাকি ‘হিন্দু জাগরণ’ ঘটেছে ! স্বয়ং সোমনাথ নিজের ধ্বংস ঠেকাতে পারবেন না কেন ?
আর মুসলমান মানেই কি শুধুই সুলতান মামুদ ? দারাশুকো নন? যিনি ফার্সিতে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন! সৈয়দ মোরতুজা নন ? যিনি অনিন্দ্যসুন্দর বৈষ্ণব পদাবলী লিখেছিলেন । মহাভারতের অনুবাদ করানো পরাগল খান নন ? আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের পাথরায় ইয়াসিন পাঠান নামে এক শ্রদ্ধেয় মানুষ নিজের অর্থে এলাকার হিন্দু মন্দিরগুলিকে সংরক্ষণ করেন। আজ যদি তাঁকে সোমনাথের মন্দিরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়, সে অপমান স্বয়ং ঈশ্বরও সইতে পারবেন তো ?
নাকি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে, ভক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, তবে মন্দিরে প্রবেশ করা যাবে ? তাহলে জেনে রাখুন, মন্দির মসজিদের ব্যবসাটাই বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, ধর্মে যে গুটি কয়েক ভাল কথা বলা আছে, তা কেউ মানে না। খারাপ কথাগুলো সবাই মানে।
অথচ, দুনিয়াটা এমন ছিল না, জানেন । প্রাচীন ভারতে এক গ্রীক রাজা বিদিশায় বিষ্ণু স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বপ্ন বাসুদেব’ পড়ুন)। সাঁচির কাছে সেই স্তম্ভ এখনও আছে। বিধর্মীর ভক্তিতে হিন্দু ধর্ম ধসে যায়নি। কলকাতার আনোয়ার শাহ রোডে আমার জীবনের অনেকগুলি বছর কেটেছে। সেখানকার দাদা পীর সাহেবের মাজারে মুসলমানদের থেকে হিন্দুরাই বেশি মানত করেন। দুর্গাপুজো কমিটিতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানরাও থাকেন। এতে কোনও ধর্মেরই কোনও ক্ষতি হয়নি। মধ্য কলকাতার ব্র্যবোর্ন রোডে ইহুদিদের যে সিনাগগগুলি আছে, তার দেখভাল করে মুসলমানরা। কারও কিছু যায় আসে না।
ও হে, আস্তিকগণ, ওহে ধর্ম বিশ্বাসীরা, বিধর্মীদের বুকে টেনে নিলে, সে তোমার ধর্মস্থানে প্রবেশ করলে, তোমার ধর্মেরই উদারতা প্রকাশ পায়। তোমার দেবতারই মাহাত্ম্য বাড়ে। কাউকে কাছে টানার ক্ষমতা যখন নেই, তখন দয়া করে তাকে দূরে ঠেলে দিও না। যে আসছে, আসতে চায়, তাকে আসতে দাও।
কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কথা। আস্তিক না শোনে যুক্তির কথা। আশ্চর্য এই ধর্মগুলো। কেউ গলায় তরবারি ঠেকিয়ে নিজের ধর্মের সদস্য বাড়ায়। না মানলে খতম করে দেয়। আর কেউ দেবতার দুয়ার থেকে মানুষকে লাথি মেরে তাড়ায়। শুধু অন্যের ধর্মের নয়, নিজ ধর্মের মানুষদেরও তাড়ায়। ২০০৬ সালে ওড়িশার কেরাদাগড় মন্দিরে দলিতরা প্রবেশ করায় সেই মন্দিরের শুদ্ধিকরণ করতে হয়েছিল। গতবছরেই বিহারের দলিত মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম একটি মন্দিরে প্রবেশ করলে মন্দিরের শুদ্ধিকরণ করা হয়।
এই পরিস্থিতিতে আমার বোনের মেয়ে, যার বাবা মুসলমান, মা হিন্দু, যে সরস্বতী পুজোর প্রসাদ আর বকরিদের গো মাংস, দুটোই খায়, সে যদি ঈশ্বরের উপাসনা করতে চায়, কোথায় যাবে বলুন তো ? সে কি মন্দির মসজিদ দু জায়গাতেই যেতে পারবে ? নাকি কোথাও যেতে পারবে না ?
যদি যেতে না পারে, তাহলে অসভ্য কে ? আমার ভাগ্নি, বোন, ভগ্নিপতি ? নাকি অসভ্য আমার দেশ, সমাজ ? নাকি অসভ্য ধর্ম ? নাকি এই সভ্যতাটাই আসলে অসভ্য ?
আস্তিকরা দয়া করে জবাব দিন। নাস্তিকরাও দিন।