রবি কর
সত্যজিৎ রায়ের প্রতি যেটুকু ভক্তি ছিল, তার অর্ধেটাই একদিনে উবে গেলমশাই।
এমনিতেই আমার বিদ্যাবুদ্ধির সুনাম বিশেষ নেই। লোকে বলে, ক্লাস সিক্সের বাচ্চার বুদ্ধিও আমার থেকে বেশি। তা, এই বুদ্ধি নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার মর্ম বোঝা সম্ভব নয়। শুধু গুপি-বাঘার সিনেমাগুলো দেখতে ভাল লাগে। রূপকথার গল্প তো। আমার মতো মাথামোটাদের জন্য ওটাই যথেষ্ট। সত্যজিতের ভুল ধরব, এমন ধৃষ্টতা থাকা উচিত নয়। কিন্তু ওই যে বললাম, মূর্খের কতগুলো সুবিধে আছে। মূর্খ হলে না বুঝেই কী অনায়াসে জ্ঞানী-গুণী মানুষদের সমালোচনা করা যায়।
এর মধ্যে হীরক রাজার দেশে সিনেমাটা আগে আমার বিশেষ ভাল লাগত না। হীরক রাজা কে, কেন তিনি খারাপ, কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু গত বছর চারেক এই না বোঝাটা কেটে গেছে। দিনে-রাতে, স্বপনে-জাগরণে ‘হীরক রাজার দেশে’দেখছি। আর সত্যজিতের প্রতি ভক্তিও বেড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আজ যা হল, তাতে বুঝলাম, সত্যজিৎকে যতটা বড় বলা হয়, ততটা বড় তিনি নন। আচ্ছা বলুন তো, হীরক রাজার দেশের হিরো কে ? কী বললেন, গুপি-বাঘা ? দূর মশাই, আপনার বুদ্ধিও তো দেখছি আমার মতোই। আসল হিরে উদয়ন পন্ডিত। সেই টোলের মাস্টারমশাই, যিনি অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই তো গুপি-বাঘা লড়াই করল। রাজা হাজার চেষ্টা করেও উদয়নের মগজ ধোলাই করতে পারেননি। বরং, তিনিই রাজার সামনে আঙুল তুলে বলেছিলেন, অনাচার করো যদি, রাজা তবে ছাড়ো গদি।
সত্যজিতের হীরক রাজা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। আশপাশের কাউকে কাউকে দেখলে আজও মনে হয়, এই তো হীরক রাজা। সেখানেও রাজা যা বলতেন, পারিষদরা বলত, ঠিক ঠিক ঠিক। এখানেও পারিষদ ও আমরলারা একেবারে একরকম। সিনেমায় যেমন, বাস্তবেও তেমন। কিন্তু উদয়ন পণ্ডিত! তিনি কি আজও তেমনই বিদ্রোহী আছেন ? নাকি তাঁরও মগজ ধোলাই হয়ে গেল?
সত্যজিৎ-ভক্তরা যাই বলুন, আমি বলব, সিনেমার উদয়নের সঙ্গে বাস্তবের উদয়নের কোনও মিল নেই। সিনেমায় উদয়নের মগজ কিছুতেই ধোলাই করা যায়নি। যন্তর-মন্তর ঘরের সামনে দাঁড়িয়েও তিনি নিজের মতে অনঢ় ছিলেন। কিন্তু বাস্তবের উদয়ন নিজেই সুড়সুড় করে যন্তর-মন্তর ঘরে এসে হাজির হয়েছেন। একেবারে নেতাজির নামাঙ্কিত বিমান বন্দরে পৌঁছে গেছেন। মগজটা বাড়িয়ে দিয়েছেন ধোলাই হওয়ার জন্য।
সিনেমার উদয়ন বলেছিল, ‘যারা রাজার ধামাধারি, তাদেরও বিপদ ভারি।’ বাস্তবের উদয়ন নিজেই ধামাধারি হয়ে গেলেন। হয়ত ভাবলেন, সামনেরবার তিনি মন্ত্রী হবেন। হীরক রাজা তাঁকে হীরের মালা উপহার দেবেন। মন্ত্রী না হোন, বিদূষক হবেন। হীরক রাজা খুশি হলে বিদূষককেও হীরের মালা দেন। বিদূষক, তোমারও তো বড় হীরার শখ। মাঝে মাঝে বিভূষণ-টিভূষণও দেন।
কিন্তু গুপি-বাঘার মতো যাঁরা হীরক রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, তাঁদের কথা উদয়ন পন্ডিত ভাবলেন না। সিনেমায় গুপি গান গেয়েছিল, রাজার শক্ত হা্তে শিক্ষা হলে শাস্তি হবে ঠিক। রাজা ধিক ধিক ধিক।
কিন্তু বাস্তবে ?
একা রাজাকে ধিক দিয়ে লাভ আছে ? সঙ্গী উদয়নকেও ধিক বলা উচিত। বলা উচিত, উদয়ন ধিক ধিক ধিক। সত্যজিতের উচিত ছিল, ভবিষ্যতের কথা ভেবে এমন একটা গান সিনেমায় ঢুকিয়ে রাখা।