অভিরূপ কুমার
দাদা, একটা ভাল ছেলে আছে। কম বয়স। ডাক্তারি পাস। খুব সুন্দর কথা বলে। ভেবে দেখতে পারেন।
সময়টা ১৯৭৭। সামনেই বিধানসভা ভোট। মোটামুটি এভাবেই সেই ‘ডাক্তারি পাস’ ছেলেটির পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় জেলা সম্পাদক সুকুমার সেনগুপ্ত ও দীপক সরকারের সঙ্গে।
ছেলেটি তখন অবশ্য একেবারে আনকোরা ছিলেন না। গ্রামে তখন ডাক্তার মানে সবাই বেশ সমীহের দৃষ্টিতেই দেখে। তার উপর এক টাকা ভিজিটের ডাক্তার। ফলে, জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে লাগল। একেবারে বাইরের জগৎ থেকে ‘বুদ্ধিজীবী’র তকমা নিয়ে হুট করে ঢুকে পড়লেন, এমনও নয়। ততদিনে দলের মেম্বারশিপ নিয়েছেন, ব্রাঞ্চ সেক্রেটারিও হয়ে গেছেন। টুকটাক বক্তৃতাও দিচ্ছেন। নিবারণ পাহাড়ির মতো জোতদারের বিরুদ্ধে পাহাড়িচক থেকে ললাট পর্যন্ত লম্বা মিছিলে সামনের সারিতেই ছিলেই এই ডাক্তারবাবু।
সুকুমার সেনগুপ্ত জেলা সম্পাদক হলেও ততদিনে তাঁর বয়স হয়ে গেছে। দলের বেশিরবাগ সিদ্ধান্ত নিতেন দীপক সরকার। দীপকবাবুরও মনে হল, ছেলেটিকে বিধানসভায় দাঁড় করানোই যায়। সাতাত্তরে দাঁড়ালেন কংগ্রেসের কৃষ্ণপ্রসাদ রায়ের বিরুদ্ধে। সেই ভোটে খুব অল্পের জন্য হেরে গেলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। আবার মন দিলেন ডাক্তারিতে। তার পাশাপাশি চলল গণ আন্দোলনও ।
পরের বছর (১৯৭৮) পঞ্চায়েত ভোট। দীপকবাবুদের মনে হল, ছেলেটাকে আরও একটা সুযোগ দেওয়া দরকার। এবার টিকিট দেওয়া হল জেলা পরিষদে। জিতেও গেলেন। প্রথমবার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত। জেলা পরিষদ চালাতে লেখাপড়া জানা লোক হলে ভাল হয়। সভাধিপতি হতে ডাক পড়ল ডাক্তারবাবুর। ১৯৭৮, ১৯৮৩, ১৯৮৮ পরপর তিনবার জেলা পরিষদে জিতলেন, সভাধিপতিও হলেন। প্রশাসনিক কাজের সূত্রে যেমন গোটা জেলা (তখন অবিভক্ত মেদিনীপুর) চষে বেড়ালেন, তেমনি সাংগঠনিক দায়িত্বও বাড়ল।
১৯৯১ । এবার নারায়ণগড় বিধানসভা থেকে দাঁড় করানো হল ডাক্তারবাবুকে। এবার অবশ্য জিতে গেলেন। এত বছর সভাধিপতি থাকার অভিজ্ঞতা, ততদিনে পঞ্চায়েতটাকে চিনে গেছেন হাতের তালুর মতো। তাঁকেই করা হল পঞ্চায়েতমন্ত্রী। ২০০১ নাগাদ মন্ত্রীসভায় অনেক পরিবর্তন আনলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ফেরাতে উদ্যোগী হলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই পঞ্চায়েত থেকে ডাক্তারবাবুকে আনা হল স্বাস্থ্য দপ্তরে।
মন্ত্রী হিসেবে খুব যে সফল, এমনটা বলা যাবে না। বরং, সুনামের থেকে দুর্নামটাই বেশি জুটত। রাশভারী মানুষ হিসেবেই চিনতেন গোটা রাজ্যের মানুষ। সেই মানুষটাকেই যেন নতুন ভূমিকায় পাওয়া গেল ২০১১-র বিপর্যয়ের পর। দলের একের পর এক শীর্ষনেতা হেরে গেলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব, নিরুপম সেন, অসীম দাশগুপ্ত, অশোক ভট্টাচার্য—তালিকাটা বেশ লম্বা। জিতলেন শুধু ডাক্তারবাবু। বিরোধী দলনেতা পদে অটোমেটিক চয়েস।
একেবারে যেন নবজন্ম হল ডাক্তারবাবুর। যেখানেই পার্টিকর্মীরা আক্রান্ত, ছুটে গেলেন, পাশে দাঁড়ালেন। রোজ মিডিয়ার মুখোমুখি হতেই হল। যে মানুষটাকে খুব একটা কথা বলতেই দেখা যেন না (যদিও বক্তা হিসেবে সুনাম ছিল, কিন্তু তা শুধু পার্টিকর্মীরাই জানতেন), সেই মানুষটাকেই নানা বিষয় নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে হল। মাঝে মাঝে বলতেন, ‘আমার কী বিড়ম্বনা। সরকারের কোন মন্ত্রী কীসব ভুলভাল বলে যাবেন, আমাকে তার খোঁজ রাখতে হয়, আমাকে তার প্রতিক্রিয়া দিতে হয়। এই বয়সে এসে এমন কাজ যে করতে হবে,কে জানত!’
বিরোধী নেতা হলেও যে দায়িত্বশীল থাকা যায়, অনেকদিন পর তা দেখল মানুষ। গত চার বছরে সরকারের এত সমালোচনা করেছেন, কিন্তু একবারের জন্যও কোনও অশালীন শব্দ বেরিয়ে আসেনি। তীব্র আক্রমণ, শানিত ক্ষুরধার যুক্তি, মাঝে মাঝে মিশে থাকে শ্লেষ। তাঁর মধ্যে যে এমন মার্জিত রসবোধ লুকিয়ে আছে, তিনি বিরোধী নেতা হলে অনেকের অজানাই থেকে যেত। মন্ত্রী থাকার সময় আপাতভাবে যে মানুষটাকে কিছুটা দাম্ভিক মনে হত, সেই মানুষটাকে যেন একেবারে অন্য চেহারায় দেখল বাংলা।
বিধানসভার ভেতর সিনিয়রদের যেমন মর্যাদা দিয়েছেন, তরুণ বিধায়কদের উৎসাহ দিয়েছেন। কী বলতে হবে, মাস্টারমশাইয়ের মতো বুঝিয়ে দিয়েছেন। তরুণ বিধায়কদের কাছেই শোনা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নিজে না বলে সতীর্থ তরুণ বিধায়কদের দিয়ে বলিয়েছেন। নিজের আলো দিয়ে অন্যদের উজ্জ্বল করেছেন।
এবার প্রায় সব জেলা সম্মেলনেই (২০ টির মধ্যে সম্ভবত ১৬ টি) ছিল তাঁর অনিবার্য উপস্থিতি। তখনই ইঙ্গিত ছিল, নেতৃত্বের ব্যাটন আসছে তাঁর হাতে। একদিকে চলছে রাজ্য সম্মেলন। অন্যদিকে, তাঁর স্ত্রীর অফিসে হানা দিয়েছে রাজ্য পুলিশ। অফিসের তালা ভেঙে, আলমারির তালা ভেঙে অপদস্থ করার চেষ্টা। ভাবা গিয়েছিল বেশ কড়া প্রতিক্রিয়া আসবে নব নিযুক্ত রাজ্য সম্পাদকের কাছ থেকে। প্রশ্নটা কার্যত উড়িয়েই দিলেন, ‘এ তো কিছুই নয়। এই তিন বছরে কত পার্টি কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে, কত লোকের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কত লোককে ঘরছাড়া হয়ে থাকতে হচ্ছে, মিথ্যে মামলায় কত পার্টিকর্মীকে ফাঁসানো হয়েছে। তার তুলনায় এটা তো কিছুই নয়।’ তাঁকে অপদস্থ করার এমন উদ্যোগ, অথচ, তিনি কী নির্বিকার! এরকম পরিস্থিতিতে আর কজন এই সংযম দেখাতে পারতেন, যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এক টাকা ভিজিটের ডাক্তার। কাজেই ডাক্তারি করে তেমন উপার্যন করতে পারেননি। রাজনীতি করে উপার্যনের কৌশলটাও আয়ত্ব করতে পারেননি। অনেকেই যেটা জানেন না, তা হল, নিজের দুই মেয়েকে নতুন বই পর্যন্ত কিনে দিতে পারেননি। অন্য এক পার্টির নেতার ছেলে এক ক্লাস উঁচুতে পড়ত। তার সেই পুরানো বইগুলো পেত সূর্যকান্তর মেয়ে রোশনারা। সেই রোশনারা একজন কৃতী অধ্যাপিকা। বাবার সুপারিশে নয়, সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। তাঁকেও কি অপদস্থ করার কম চেষ্টা হয়েছে ! এফ আই আর করা হয়েছে, তিনি নাকি ছাত্রীদের হার চুরি করেছেন। অথচ, রোশনারা সেদিন ছিলেন সায়েন্স কংগ্রেসে। স্বয়ং উপাচার্য যার সাক্ষী। বাবা হলেও সেদিন মেজাজ হারাননি, বেশ সংযতই ছিলেন সূর্যকান্ত।
তাঁর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখাকে গিয়ে একটা মজার কথা জানলাম। মেয়ে দেখতে গিয়ে তাঁর তিনটি প্রশ্ন ছিল। এক, বলুন তো সিপিএম, সিপিআই আর নকশাল এই তিন পার্টির মধ্যে তফাত কী ? দুই, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের শিকড় কতদূর বিস্তৃত ? তিন, আমি যদি চাকরি না করে পার্টি হোলটাইমার হই, আপনার আপত্তি আছে ?
একবার ভাবুন তো, গোটা রাজ্যে এমন একটা মানুষ খুঁজে পাবেন, যিনি বিয়ে করতে গিয়ে এমন প্রশ্ন করেছেন! না, পাত্রীর চেহারা, কতদূর লেখাপড়া করেছেন, তিনি রান্না জানেন কিনা, এসব কোনও ব্যাপারেই আগ্রহ ছিল না। এই উদাহরণটা তুলে ধরা হল, সব ব্যাপারেই তিনি কেমন ব্যতিক্রমী, এটা বোঝাতে। এমন অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।
মানুষটা সত্যিই বড় অন্যরকম। চারপাশের রাজনীতি থেকে যখন মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে, তখন এমন মানুষ আছেন। তাই ভরসা জাগে। নতুন ভোরের ভরসা। সূর্যোদয়ের ভরসা।
আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি, কার তাতে কী !