পাশ দিয়ে বয়ে চলেছেন রূপনারায়ণ। একটু দূরেই শরৎচন্দ্রের বাড়ি। সাহিত্যের তীর্থস্থানে পিকনিকের নামে ডিজে আর মাতালদের দাপাদাপি। আজ শরৎচন্দ্রের মৃত্যুদিনে সেই ছবিটাই তুলে ধরলেন অন্তরা চৌধুরী।।
গতকাল গিয়েছিলাম শরৎচন্দ্রের বাড়ি দেউলটি। যেখানে জীবনের শেষ ঊনিশটা বছর কাটিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। ট্রেনে যেতে যেতে তাঁর বাড়ির দৃশ্যকল্পটা ভাবছিলাম। আটচালা বাড়ি। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ নদী। কলকাতার জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের জৌলুস ছেড়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দেউলটির মত অনাড়ম্বর একটি গ্রামকে।
বাগনান আর কোলাঘাটের মাঝে ছোট্ট একটি স্টেশন দেউলটি। সেখানে নেমে রওনা দিই তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে। গ্রামটা দেখে মনে হচ্ছিল বেশ ছায়া সুনিবিঢ় শান্তির নীড়েই সবাই বসবাস করছে। এই গ্রাম এখনও তার নাবালকত্ব বজায় রেখেছে। সাবালক হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে নাম লেখায়নি। কিন্তু যতই এগোতে থাকি ততই ভুল ভাঙতে থাকে। শরৎচন্দ্রের বাড়িতে দেখি তিল ধারণের জায়গা নেই। চারিদিকে অগুন্তি লোক। তাদের সম্মিলিত কলকণ্ঠ মাছের বাজারকেও হার মানায়। একঝলক দেখে মনে হবে, আহা! বাঙালি কতই না শরৎ অনুরাগী। কিন্তু দুঃখের বিষয় এঁরা কেউই শরৎ অনুরাগী নয়। এরা সকলেই সেলফি অনুরাগী।
নিজের চোখের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়েছে। নিজের চোখে দেখার চেয়ে সারাক্ষণ মোবাইলে ছবি তুলতেই ব্যস্ত। বাড়ির ছবি যত না তুলছেন, সেলফির ধুম তার থেকে ঢের বেশি। ফেসবুকে চারটে বোকা বোকা লোক না জেনে না বুঝে লাইক দেবে, আর ততোধিক বোকা কমেন্ট দেবে। সেই সস্তা কমেন্টের লোভে আট থাকে আশি পোস্টাচ্ছে ‘শরৎচন্দ্রের বাড়িতে আমি’। আহা, যেন বাড়িটা ধন্য হল! নীরবতা পালন দূরে থাক। অসভ্যতা আর ন্যাকামো দেখলে এই শীতেও মাথা গরম হয়ে যাবে। বাড়ির সামনে দেওয়ালে লেখা আছে শরৎচন্দ্রের সেই অমোঘ বাণী ‘সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই…’ সেই লেখা পড়ে এক মহিলা বলেই ফেললেন –বাংলাটা যেন কেমন না! এরকম ভাষায় কেন লিখেছে? গণতান্ত্রিক দেশ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভাগ্যিস আছে। না হলে শরৎচন্দ্রের এই দুর্দশা হবে কেন।
খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছিল, ছেলে মেয়েকে আপনারা বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করেন না। বাংলায় বলাটা আপনাদের কাছে ভীষণ অপমানজনক। ছেলে মেয়ের ‘বেঙ্গলি’তে কম নাম্বার পাওয়াটা আপনাদের কাছে স্ট্যাটাস সিম্বল। সেই আপনারা কি জন্য এরকম একটা পবিত্র জায়গাকে অপবিত্র করতে এসেছেন? এখানে আসতে হবে, কে এমন মাথার দিব্যি দিয়েছিল? শরৎচন্দ্র কে ছিল জানেন? শাহরুখ খানের দৌলতে হয়তো ‘দেবদাস’ নামটা জানেন। এছাড়া আর একটা উপন্যাসের নামও বলতে পারবেন? অন্তত একটা ছোটগল্প! ‘শরৎচন্দের বাড়িতে আমি’ ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দিয়ে ভাবছেন বিরাট দেশোদ্ধার করে দিয়েছেন।
এই বাড়িতে বসেই লিখেছিলেন পথের দাবী, বিপ্রদাস, শ্রীকান্ত–র তৃতীয় খণ্ড। এই তো, ওই টেবিলে লিখছেন শরৎচন্দ্র। ওই সেই ইজিচেয়ার, বারান্দায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সেই দৃশ্যকল্পগুলো আসছে, মনে মনে রোমাঞ্চিত হচ্ছি। আর সেই রোমাঞ্চ হারিয়ে যাচ্ছে সেলফি–দানবদের অসভ্যতায়। মুগ্ধতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল বিরক্তি।
অবাক হওয়ার এখনও অনেক বাকি। শরৎচন্দ্রের বাড়ি থেকে হাত দশেক দূরে চলছে আধুনিক শব্দ দানব ডিজে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পিকনিক করতে আসছে এখানে। চারিদিকেই গান চলার ফলে কেউই সেই গান শুনছে না। অবশ্য ডিজে থেকে বেরনো আওয়াজকে গান বললে গানকে অপমান করা হয়। ছেলেগুলো তো মদ খাচ্ছেই তার সঙ্গে মেয়েদের কাছে এখন মদ খাওয়া, স্মোক করা আর উদ্দাম নৃত্য হয়ে উঠেছে ‘কালচার’ এর ডেফিনেশন। আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতির অপমৃত্যু এভাবে চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে। এরকম পৈশাচিক উল্লাস করে মানুষ যদি আনন্দ পায় তবে পাক। আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু ওইরকম একটা পুণ্যভূমিতে কেন? দেশে কি আর জায়গা ছিল না কোথাও? প্রশাসন বোধহয় শীত ঘুম দিচ্ছে। এই অসভ্যতা থামানোর ন্যূনতম সদিচ্ছাটুকুও আছে বলে মনে হল না। অথবা বদলে যাওয়া সময়ে তাঁদের কাছেও এটাই হয়তো কালচার।
একটা শিব মন্দিরের ওপরে দেখলাম লেখা আছে শরৎচন্দ্রের বাণী-‘মানুষের মরণ আমাকে কষ্ট দেয় না। কষ্ট দেয় মনুষ্যত্বের মরণ দেখলে।’ এভাবেই মানুষ দেবতা হয়ে যায়। না হলে মন্দিরের গায়ে শিবের মন্ত্রের বদলে শরৎচন্দ্রের কথা লেখা থাকবে কেন?
আজ শরৎচন্দ্রের মৃত্যুদিন। মনে হচ্ছিল, তিনি মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। বেঁচে থাকলে, এই অসভ্যতা রোজ দেখতে হলে নিজেই হয়ত রূপনারায়ণে ঝাঁপ দিতেন। একটু নিরিবিলিতে থাকবেন বলে কলকাতার হাতছানি ছেড়ে এসেছিলেন এই গ্রামে। পিকনিকের নামে সেই নিরিবিলির দফারফা করে দিচ্ছি আমরা। আমাদের দৌলতেই প্রতিদিন তাঁর আদর্শের অপমৃত্যু হচ্ছে। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন তরোয়ালের থেকে কলমের জোর বেশি। এই প্রতিবাদ যদি গুটিকয়েক মানুষেরও চৈতন্যের উদয় ঘটায় তবে সেটাই হবে তাঁর মৃত্যুদিনে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।