স্বরূপ গোস্বামী
সবকিছুই বেশ গুলিয়ে যাচ্ছে। একদিকে উত্তর প্রদেশ ভোটের আগে বি জে পি যুদ্ধ যুদ্ধ জিগির তুলছে। অন্যদিকে আরেক শ্রেণি আছে, যারা সংখ্যালঘু তোষণের রাস্তা বেছে নিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন ঘটনায় মেরুকরণ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। আর এই অবস্থায় যাঁদের অবস্থান একটা স্পষ্ট দিশা দেখাতে পারত, তাদেরই যেন দিশাহীন মনে হচ্ছে।
সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতটাকে আপাতত দূরে সরিয়ে রেখে আমাদের রাজ্যের কথায় আসা যাক। দিন কয়েক আগে সিদ্দিকুল্লার উদ্যোগে বিশাল এক সভা হয়ে গেল। সিদ্দিকুল্লা এখন কোন দলের, সেটাই গুলিয়ে যায়। একদিকে তৃণমূলের টিকিটে নির্বাচিত মন্ত্রী, আর তৃণমূলের টিকিটে মন্ত্রী হলে তাঁর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে কিনা, সেও এক প্রশ্ন। এই সিদ্দিকুল্লা সাহেব মাঝে মাঝেই এরকম সমাবেশ ডাকতেন, গরম গরম কথা বলতেন। এভাবেই নিজের দর বাড়াতেন । দর যে বাড়াতে পেরেছেন, তা তো তাঁর গাড়ির সামনের লালবাতি দেখলেই বোঝা যায়।
যথারীতি এবারও তিনি বড় মাপের একটা সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন। তৃণমূল নেত্রী নিজে না গিয়ে পার্থ চ্যাটার্জি, ববি হাকিমদের পাঠিয়েছিলেন। পার্থবাবুর বক্তৃতা শুনে বোঝা গেল, শিখিয়ে পড়িয়েই পাঠানো হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলে বসলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকব কিনা, সেটা কি অন্য কেউ ঠিক করে দেবে?’ কোনও রাখঢাক নেই, একেবারে প্রকাশ্যেই তালাক প্রথার হয়ে সওয়াল করলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। হিন্দু ধর্মেও নানা গোঁড়ামি ছিল (এখনও আছে), সেগুলোকে সমর্থন করার মতো লোকও ছিল। বোঝা যাচ্ছে, ধর্মের নামে যে কোনও অনাচারকে সমর্থন করার মতো লোক এখনও আছে। এমনকি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীরও তালাকের পক্ষে সওয়াল করতে আটকায় না।
পার্থবাবু কি নিজে থেকে এমনটা বললেন ? তাঁর উদর যতই স্ফিত হোক, এতবড় বুকের পাটা যে নেই, সেটা বুঝতে বিশেষ বুদ্ধির দরকার হয় না। অর্থাৎ, পার্থবাবুর এই মন্তব্যে নেত্রীর সম্মতির সিলমোহর আছে। সহজ কথা, মুখ্যমন্ত্রী কী চাইছেন, সেটা পরিষ্কার।
কিন্তু বামপন্থীদের অবস্থান কী ? সূর্যকান্ত মিশ্র নম নম করে বিরোধীতা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তারপরই এমন কিছু বলেছেন, যাতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে গেছে। অন্য বাম নেতাদার মন্তব্যেও স্পষ্ট অবস্থান নেই। তালাক নিয়ে দায়সারা গোছের দু একটা লাইন, তারপরেই বিজেপি নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠা। আসল প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া।
ক্ষমতায় থাকার অনেক বাধ্যবাধকতা আছে। তাকে অনেক জায়গায় আপোস করতে হয়। বিরোধীদের এমন বাধ্যবাধকতা নেই। সহজ কথা, যদি মনে হয় তালাক ঠিক,তাহলে সেটা স্পষ্ট করে বলুন। আর যদি মনে করেন, তালাক প্রথা তুলে দেওয়া উচিত, তাহলে সেটাই স্পষ্ট করে বলুন। মিন মিন করে দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় নয়, একেবারে স্পষ্ট ভাষায় বলুন। দরকার হলে আরও একটা প্লেনাম ডাকুন।
কমরেড মনে রাখবেন, ঠিক হোক, ভুল হোক, এই প্রসঙ্গে মমতার নির্দিষ্ট একটা অবস্থান আছে। বিজেপি-রও একটা অবস্থান আছে। কিন্তু আপনাদের অবস্থানটা বেশ ঘোরালো।সবাইকে একসঙ্গে খুশি রাখা যায় না। তৃণমূল তালাক চাইছে, তাই তাদের সমালোচনা করতে হবে। আবার বিজেপি তালাক তুলে দিতে চাইছে, তাই তাদের সমালোচনা করব- এই দ্বিমুখী অবস্থান ছেড়ে বেরিয়ে আসুন।
নিজেরা আলোচনা করুন। নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করুন। পরিষ্কার করে বলুন আপনারা তালাক রাখার পক্ষে নাকি তুলে দেওয়ার পক্ষে ? যদি মনে হয় সমাজ ও সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে, এখন আর সেই প্রাচীন আমলের নিয়ম মানার যুক্তি নেই, সেটা প্রকাশ্যে বলুন। তাতে সেই সুর যদি বিজেপি-র সঙ্গে মেলে, তবে মিলতে দিন। মনে রাখবেন, এখন স্পষ্টতাই কিন্তু সময়ের দাবি।।