সফিউল ইসলাম
পার্টির সদস্যপদ পাই আটের দশকে। সক্রিয়ভাবে দলের সঙ্গে যুক্ত তারও আগে থেকে। জেলা স্তরে বা জোনাল স্তরেও কখনও রাজনীতি করিনি। ব্রাঞ্চ, লোকালের ছোট্ট চৌহদ্দিতেই কাজ করেছি। যতটা সম্ভব মানুষের সঙ্গে মিশেছি। তাঁদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছি।
পার্টির নানা কাজকর্ম নিয়ে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে। কোথায় বলব, কাকে বলব, জানি না। আমার মতো অনেকেই হয়ত এগুলো নিয়ে ভাবেন। মনে মনে কষ্ট পান। দলের কথা দলের বাইরে বলতে নেই, এটুকু জানি। কিন্তু দলের ভেতর, যে পরিমন্ডলে আমরা থাকি, সেখানে বললে সেই আওয়াজ কখনই রাজ্যস্তরে পৌঁছবে না। তাই কিছু গঠনমূলক সমালোচনা এই লেখার মাধ্যমেই করতে চাই।
আবার একটা কথা কাগজে পড়ছি। আমাদের রাজ্য সম্পাদক নাকি ফুরফুরা শরিফে গিয়ে গোপন বৈঠক করে এসেছেন। ফুরফুরা শরিফে নাকি বিমান বসু যাবেন। আরও বেশ কয়েকবার এই বৈঠক হবে। এতদিন অন্যান্য দলগুলো এই বৈঠক করত। এখন আমরাও করতে শুরু করেছি। আপনারাও তাহলে বিশ্বাস করেন ফুরফুরা শরিফের ইব্রাহিম বা ত্বহা সিদ্দিকি যা বলবেন, মুসলিমরা তাই করবেন ? এই যদি ভাবনা হয়, তাহলে ভেবে দেখুন, মুসলিমদের আপনারা কতটা ছোট করে দেখছেন ? তাদের চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধি, বিবেচনার উপর কোনও আস্থা নেই ?
আমি নিজেও একজন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। ধর্ম সম্পর্কে যতটা সম্ভব উদাসীনই থাকি। গ্রাম বাংলায় থাকার কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে। কিছু লোকাচার হয়ত মানতে হয়। এই বাধ্যবাধকতা আপনারা বুঝবেন বলে মনে হয় না। আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা ত্বহা সিদ্দিকির ফতোয়া মেনে ভোট দেয় না। আমরা আগে বিরোধীদের কটাক্ষ করতাম, ভোটের আগে তারা মসজিদে বা ইমামের কাছে ছুটত বলে। এখন আমরাও তো সেই পথেই হাঁটছি।
রেজ্জাক মোল্লা তো দলের ভেতরেই দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন তুলছিলেন। সংগঠনে আরও বেশি করে মুসলিম নেতাদের তুলে আনার কথা বলছিলেন। তাঁকে আপনারা ব্রাত্য করে দিলেন। বহিস্কার করে দিলেন। আর আজ একই কথা যখন ত্বহা সিদ্দিকি বা ইব্রাহিমের মতো লোকেরা বলছেন, তখন সেটা অমৃতসমান মনে হচ্ছে।
এ বড় কঠিন সময়। সুখের পায়রাগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই উড়ে গেছে। এখনই তো নিজেদের নীতিকে আরও বলিষ্ঠ করার সময়। আর এই সময়েই আপনারা কিনা সেই চরম সুবিধাবাদী রাস্তায় হাঁটছেন ? ভোটের জন্য ফুরফুরায় ছুটতে হচ্ছে ?
এটা ঘটনা, এই রাজ্যে ৩৪ বছর বামেরা থাকার পরেও সংখ্যালঘুদের আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। এই সমালোচনা স্বীকার করুন। একজন মহম্মদ সেলিমকে পলিটব্যুরোতে আনলে হবে না। লোকাল বা জোনাল স্তরে সেই প্রতিনিধিত্ব কই ? উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ – এই তিন জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি। সেখান থকে সংগঠনের শীর্ষে কাউকে আনা গেল না ? এগুলো কর্মীদের মনে কীভাবে রেখাপাত করে, আপনারা হয়ত কলকাতায় বসে তা বুঝতে পারেন না। নিচুতলায় আমরা কোনও জবাব দিতে পারি না।
উপরতলায় কজন মহিলা রইলেন, কজন সংখ্যালঘু রইলেন, তার চেয়েও বেশি জরুরি, নিচের দিকে কতজন রইলেন। লোকে সেটাই সবার আগে দেখে। সংখ্যালঘুদের জন্য সত্যিই কতটা কাজ করতে পারলেন, সেটা মানুষ দেখে। বলার মতো কাজ কি আমরা সত্যিই করতে পেরেছি ? পারিনি। এই কথাটা অকপটে স্বীকার করুন। সত্যিটা স্বীকার করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। মুসলিমদের আমরা শুরু ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করেছি কিনা, দলের মধ্যে তার পর্যালোচনা করুন। কঠোরভাবে আত্মসমালোচনা করুন।
ফুরফুরা শরিফের পিরজাদার কাছে যাওয়াটা সমাধান নয়। সেটা প্রায়শ্চিত্তও নয়। প্রায়শ্চিত্ত যদি করতে চান, মুসলিমদের আগে ভোট ব্যাঙ্ক ভাবা বন্ধ করুন। লড়াইয়ের সাথী বলে ভাবতে শিখুন।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন। মতামত লেখকের নিজস্ব।)