স্বরূপ গোস্বামী
গৌতম দেব সমীপেষু
সেদিন সত্যিই আপনাকে ভাল লেগেছিল। সত্যিই এতখানি সৌজন্য আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। ঠিক তার এক সপ্তাহ আগেই কলকাতায় এসেছিলেন অশোক ভট্টাচার্য। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল সুব্রত মুখার্জি ও ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে। দুজনের কেউই দেখা করেননি। অপমানিত হয়ে মহাকরণ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল কুড়ি বছরের পুরমন্ত্রী ও বর্তমানে শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যকে।
বাম জমানায় কোনও প্রাক্তন মন্ত্রী বা কোনও শহরের মেয়রকে এভাবে অপমানিত হতে হয়েছিল ? থাক সে কথা। তার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই আপনার সঙ্গে উত্তরকন্যায় দেখা করার কথা অশোক ভট্টাচার্যর। মহাকরণের অভিজ্ঞতা ভাল ছিল না। তাই মনে মনে ভেবেছিলেন, আর যেচে অপমানিত হতে যাবেন না। এমন সময় আপনি বললেন, ‘আমি যখন সময় দিয়েছি, আমি অপেক্ষা করব।’ বোধ হয় সেই আশ্বাসেই উত্তরকন্যায় গেলেন অশোকবাবু। না, সেদিন আপনার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশ ছিল না। আপ্যায়নে, আন্তরিকতায় কোনও ত্রুটি রাখলেন না। একজন মন্ত্রী ও মেয়রের বৈঠক যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে হওয়া দরকার, তাই হয়েছিল। মেয়রকে পাশে বসিয়ে প্রেস কনফারেন্স করলেন। যাবতীয় তিক্ততা দূরে সরিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বললেন। শহরের উন্নয়নে হাত ধরাধরি করে পথ চলার কথা বললেন। নিজে নিচ পর্যন্ত নেমে এসে অশোকবাবুকে গাড়িতে তুলে দিলেন।
গৌতমবাবু, সেদিন সত্যিই আপনাকে ভাল লেগেছিল। রাজ্যের মানুষ এই সৌহার্দ্যের ছবিটাই তো দেখতে চান। সাংবাদিকতার সূত্রে বছর দেড়েক আপনার শহরে ছিলাম। কিছুটা দেখা, কিছুটা শোনা, সবমিলিয়ে আপনার নানা ‘কর্মকাণ্ড’ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই একটা স্বচ্ছ ধারনাও আছে। যতই লালবাতি জ্বালা ইনোভাতে চড়ুন, বিশ্বাস করুন, কখনই আপনাকে মন্ত্রী মনে হয়নি। বড়জোর একজন পাড়ার কাউন্সিলর মনে হত। সেদিন মনে হয়েছিল, চার বছর পর, এতদিনে আপনি মন্ত্রী হলেন।
তারপর কী হল, আপনিও জানেন, আমরাও জানি। তখনও ২৪ ঘণ্টা পেরোয়নি। শোনা গেল, উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে আপনাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সৌহার্দ্যের ফল কী হতে পারে, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন।
হ্যাঁ, গৌতমবাবু, আপনি এমনই একটি দল করেন, যেখানে অসভ্যতাকেই উৎসাহিত করা হয়, সৌজন্যকে নয়। নেত্রী নিজে ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে সৌজন্য দেখাবেন। মহিমা কীর্তন করার জন্য নানা মিডিয়া আছে। কিন্তু সেই সৌজন্যের ক্ষীর আপনি খাবেন, তা তো হয় না।
তাই সেদিন সহযোগিতার বার্তা দিলেও আবার স্বমহিমায় ফিরে এলেন। আবার মন্ত্রী বনাম মেয়র বিবৃতির যুদ্ধ চলতেই লাগল। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলেন রবিবার। মাটিগাড়ায় অশোক ভট্টাচার্য-জীবেশ সরকারদের মিছিল আক্রান্ত হল। এর পেছনে আপনার হাত, কেউ কিন্তু বলেনি। হতেই পারে, স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব নিজেদের নম্বর বাড়ানোর জন্য অতি উৎসাহে এই কাণ্ড করে ফেলেছে। থানায় নালিশ হল। অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বাম নেতৃত্ব সোচ্চার হলেন।
মন্ত্রী হিসেবে আপনি বলতেই পারতেন, খোঁজ নিয়ে দেখছি। বা পরে বলতেই পারতেন সিপিএম নাটক করছে। সামান্য ঘটনাকে বড় করে দেখাচ্ছে। এই পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল। আপনি কী করলেন ? মন্ত্রী হয়ে হাসমি চকের কাছে ধর্নায় বসে গেলেন। এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে, আপনি ধর্নাতেও বসছেন, আবার সেই ধর্না থেকে পুলিশকে নির্দেশও দিচ্ছেন। আসলে, হঠাৎ করে মন্ত্রী হয়ে গেছেন তো। তাই ন্যূনতম শিষ্টাচারগুলোও শিখে উঠতে পারেননি। কাদের কাছে শিখবেন ? যাঁদের ছবি টাঙিয়ে রাখেন, তাঁদের কাছ থেকে ভাল শিক্ষা পাওয়ার আশা কম।
ধর্নার পরে কী করলেন ? অশোক ভট্টাচার্য-জীবেশ সরকারের নামে এফ আই আর করা হল। যেমন তেমন এফ আই আর নয়, তাঁরা নাকি এক মহিলার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁর শ্লীলতাহানি করেন! আপনার নির্দেশ ছাড়া এই এফ আই আর হয়েছে, এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। অশোক ভট্টাচার্যর নামে রাজনৈতিকভাবে নানা অভিযোগ করতেই পারেন। তাই বলে শহরের মেয়রের নামে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ? দল বেঁধে তিনি শ্লীলতাহানি করতে যাবেন! অশোক ভট্টাচার্যর অতি বড় নিন্দুককেও বিশ্বাস করাতে পারবেন ? রাজনীতিতে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতির লড়াই থাকে। তাই বলে এত নিচে নামতে হয়!
গৌতমবাবু, সেদিন আপনাকে ভাল লেগেছিল।
কিন্তু আজ আপনাকে কী বলি বলুন তো !
রাগ না করে করুণা করাই বোধ হয় ভাল। সত্যিই, আপনারা বড় অসহায়। নেত্রীর ‘সুনজরে’ থাকতে আপনাদের কত নিচে নামতে হয়!