সবুজ সরখেল
পাড়ার মাঠ লাগোয়া যে মঞ্চটা আছে আমাদের সেটায় দেখলাম নতুন রং হচ্ছে। কেষ্টদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুজো’র এখনও তো অনেক দেরি, তাহলে এত তাড়াতাড়ি রং হচ্ছে যে ?’ কেষ্টদা উনুনে গরম জল চাপিয়ে বলল, ‘বাচ্চুবাবু পাড়ার খবর যে দেখছি কিছুই রাখছো না আজকাল! ক্লাবে যে নতুন ব্যামের ক্লাস শুরু হচ্ছে গো’। কাঞ্চন দেখি হাতে করে একটা পেল্লাই সাইজের প্ল্যাকার্ড নিয়ে আসছে। লেখা “নবোদয় স্পোর্টিং যোগা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র”। প্ল্যাকার্ডটার জন্যই বোধ হয় কাঞ্চন ঠিক দেখতে পায়নি, পাশের গলি থেকে বেরোনো ঘন্টুদা’র সঙ্গে লাগলো ধাক্কা। কাঞ্চন অবশ্য ঠিক ব্যালেন্স করে সামলে নিয়ে মাঠে ঢুকে গেল। ঘন্টুদা প্রথমটা চমকে গেলেও প্ল্যাকার্ড দেখে কেমন যেন বমকে গেল। এমনকি কাঞ্চনকে ধমক পর্যন্ত দিতে ভুলে গেল! স্বগতোক্তি করতে করতে রকে এসে বসে পড়লো। “এখানেও?” বললাম, কী এখানেও? যোগা দেখে বলছ ? ’ঘন্টুদা বললো “আর বলিস না ভাই, অফিসে পর্যন্ত যোগা যোগা করে মাথা খেয়ে দিচ্ছে, এই বয়সে এই শরীরে হয় বলদিকি?”
কেষ্টদা অমনি বললো ‘কেন ঘন্টুদা, ছেলেগুলো সারাদিন ধরে হয় ফুটবল নয় ক্রিকেট বল প্যাঁদাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটা চলার উপায় নেই, এ’গুলোও তো খেলার মধ্যে পড়ে নাকি! তা কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে এই সব শিখুক, আমাদেরও একটু স্বস্তি হয়’।
ঘন্টুদা বললো, “কেষ্ট, ওতে ওরা শান্ত হওয়ার হলে আগেই হয়ে যেত। এইসব আসন-টাসন তো আর নতুন কিছু নয়, আমরাও স্কুললাইফে এইসব করেছি। এতে তোমার কিছু সুবিধা হবে না। কারণ এ’সব করেও ওরা বল পেটাবেই’।
পল্টু জুড়ে দিল, ‘কেষ্টদা, আরও জোরে জোরে বল মারবে গো। যোগা করে শক্তি বাড়বে না’!
ঘন্টুদা শুনে বলল “তাই নাকি পল্টু ? কী দুর্দশা! এইসব পাবলিক দিয়ে নাকি ভারত বিশ্ব যোগ দিবস করছে! তা তোরও তো অ্যাডিশনালে ওয়ার্ক এডুকেশনই ছিল, তা ফিজিক্যাল এডুকেশনের ব্যামগুলো অভ্যাস করে গায় এতোটুকু শক্তি জোগালো না যে দুর্গা ঠাকুর তোলার সময় ট্রাকের আসপাশে থাকিস। তখন তো দেখি সটকে যাস।” ব্যাপারটা যে ঘন্টুদা নোটিশ করেছে পল্টু জানতো না। একদম চুপ মেরে গেলো। আমি দেখলাম চেনা সাবজেক্ট পেয়েছি, জ্ঞান প্রকাশের এই সুযোগ কে ছাড়ে!
বললুম, সত্যিই তো যোগ তো আমাদের দেশেরই প্রোডাক্ট।, আবার নতুন মোড়কে ফিরে আসছে, সেই কবে থেকেই তো জানা। গোটা বিশ্ব আমাদের দেখে শিখেছে। এ তো নেহাৎ ঘরের টোটকায় আস্থা ফেরা……”
ঘন্টুদা মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো, “এই যেমন তোদের ময়দানে দেশের প্রোডাক্টে আজকাল নতুন করে আস্থা ফিরছে, তাই তো? তা হ্যাঁরে এবার কি তবে ফিজিক্যাল ট্রেনারের বদলে যোগগুরু রাখবে নাকি তোদের ক্লাবগুলো? তো তাঁরা কি দেশীয় হবেন নাকি বিদেশি? গুরু টুরুরা তো ময়দানে এখন ভালই ঘোরাফেরা করে!”
বুঝলাম, ঘন্টুদা’র ইঙ্গিত কোন দিকে। মজা করে বললাম ‘তোমার সন্ধানে আছে নাকি কেউ?’
ঘন্টুদা বললো, “না ভাই, আমার তো ফিফা’র লাইসেন্স নাই, তাইএজেন্ট হতে পারবো না। তোরা বরং ওই কার্তিককে বাজিয়ে দেখতে পারিস। তবে এক ক্লাবে কার্তিক থাকলে অন্য ক্লাবে কে যাবে এটা প্রশ্ন। সেক্ষেত্রে রবিনসন স্ট্রিটের মর্ডান তান্ত্রিককেও বাজিয়ে দেখতে পারিস”।
আমি রেগে গিয়ে বললাম ‘ঘন্টুদা, তুমি, যোগ আর তন্ত্র গুলিয়ে ফেলছো।’
ঘন্টুদা’র পাল্টা উত্তর, “তোরা লুকাস, ডায়মন্ড স্টারদের ফুটবলার বলে গুলিয়ে ফেলতে পারিস। কার্তিককে ত্রাতা বলে গুলিয়ে ফেলতে পারিস। আর যোগা, তন্ত্র নিয়ে মশকরা করে আমি গুলিয়ে ফেললেই দোষ! আর সত্যিই তো একজন বাঙালি কোচ শত সমস্যা পেরিয়ে আই লিগ জিতে দেখাবার পর তবে স্বদেশি কোচেদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে তোদের ময়দান। তা সেটা যোগে ফিরে যাওয়ার মতই অনেক দেরী করে টনক নড়া ছাড়া আর কি বাবা! তা সেটাও আমেরিকা, ইউরোপ করলে তবে ভারতীয়দের চোখে আজ জাতে উঠছে।’’
আমি চুপ। বুঝলাম, আর আমার আর যুক্তি নেই। বাচ্চু এবার নেহাৎ বাচ্চা, যাকে বলে শিশু আর কি!
ঘন্টুদা বলে গেল, “তাও পুরোপুরি আস্থা রাখছে কোথায়? এই তো শুনলাম মরগ্যানের সঙ্গেও নাকি কথাবার্তা বলাই আছে”।
পল্টুদা প্রতিবাদ করে উঠলো “কে বলেছে ? বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পুরো এক বছরের চুক্তি। সবটা উনিই করবেন হয়তো আই লিগের আগে……”
ঘন্টুদা বললো, “আই লিগের আগে মানে! মানে শুধু কলকাতা লিগ তো ? কারণ, আর সব ট্রফি তো এআইএফএফ তুলে দিয়েছে ভাই! আইএফ এ শিল্ডে বাচ্চারা খেলে, ফেড কাপ ভোগে, ডুরান্ডে কলকাতার ক্লাব যায় না! আজ আর মরশুমে পাচে পাচ ট্রফি হয় না ভাই। ৩ টে উঠে গেছে, আই এস এল’র ধাক্কায় কলকাতা লিগও এবার হাফ, মানে দাঁড়ালো পাঁচের বদলে দেড়খানা ট্রফি। তার মধ্যে আই লিগের আগে বিদেশি কোচ আস্তে পারে ? তাহলে দাঁড়ালো কী? আধখানা ট্রফিতে বাঙালি কোচে ভরসা!”
কাঞ্চন কখন এসে দাঁড়িয়েছে এর মাঝে, মিহি গলায় বললো, ‘আমাদের ক্লাবে কিন্তু এমন কিছু নেই।’
ঘন্টুদা’র উত্তর, “থাক, আর আমাদের তোমাদের করতে হবে না। সেখানে তো একটা ইষ্টবেঙ্গল ম্যাচ জিতলেই কর্তাদের হট যোগ শুরু। একদিনের নোটিশেই কোচ বিয়োগ। সব সাফল্য ভুলতে একটা ম্যাচই কাফি।”
কথাগুলো অস্বীকার করা যায় না। কাজেই কাঞ্চন আর পল্টুকে দেখলাম, ধীরে ধীরে মাঠের দিকে এগোচ্ছে। বললাম ‘কিরে কোথায় যাচ্ছিস, উত্তর দে’। পল্টু বলল ‘না, মানে কেষ্টদা’র ঘুঘনিটা একটু বেশিই হয়ে গেছে, একটু কপালভাতি করে আসি, হজম হয়ে যাবে’।