সবুজ সরখেল
পাড়ার মণ্ডপে কানাই পাল এক মনে মায়ের মূর্তি গড়ছিলেন, হাবুলদার ছেলে পিকলু হঠাৎ কোথা থেকে এসে সটান মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখল মিনিট খানেক, তারপর কানাইদা’কে বলল ‘ কানাই দাদু, টুবাই কাকা বলল এবার নাকি অশূরের মুখ পেলের মত হবে? নতুন থিম! সত্যি গো?’
কানাইদা বহু দিন থেকে আমাদের পাড়ায় দুর্গাপুজোর মূর্তি করেন। সেই ছোট থেকে দেখছি ওকে, খুব গম্ভীর স্বভাবের, পাড়ার ছোট ছেলেদের সঙ্গে কথা বললেও চ্যাংড়া ছোকরাদের সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে কথা বিশেষ বলেন না। খুব সাত্তিক মানুষ, পুজো আচ্চা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করাও একেবারে না পসন্দ কানাইদা’র। কথাটা শুনে আমার দিকে শুধু একবার তাকালেন। আমি ভয়ে ভয়ে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘ টুবাই বোধহয় মজা করেছে কানাইদা। এমন কোন প্ল্যানের কথা তো শুনিনি। তুমি তোমার মত কাজ চালিয়ে যাও’।
পিকলুকে ধমক দিয়ে নিয়ে মোড়ের রকে এসে বসলাম। দেখি টুবাই হাত পা নেড়ে কি সব বোঝাচ্ছে। সামনে বসে বুবুন, বাপ্পা আর ঘন্টুদা। রবিবারের ছুটির সকাল, জমজমাট পাড়া। টুবাইকে বললাম, ‘এই তুই পিকলুকে কী বুঝিয়েছিস? অশূরের মুখ নাকি পেলের মতো হবে? কানাইদা চোটে আগুন কিন্তু।’ টুবাই বলল, ‘ না রে অশূরের মুখ হবে না, তবে পুজোর সময় যখন বস আসছেই শহরে, তখন লাইটিং এ তো অন্ততঃ রাখবোই বসকে।’ ঘন্টুদা এবার মুখ খুলল, ‘ তা লাইটিং এ পেলে আসছে কী ভাবে ? হলুদ-সবুজ এলইডি দিয়ে ? তা তিনি কী ভঙ্গিমায় থাকবেন বাবা? কাচি হাতে মণ্ডপের সামনে ফিতে কাটার?’ টুবাই উৎসাহ নিয়ে বলতে বসল, ‘ না ঘন্টুদা, ঠিক করেছি মাঠের ঠিক গেটে একটা কাট আউট থাকবে, চন্দনগরের লাইট দিয়ে, বিশাল সাইজের। পেলে দৌড়ে এসে বল মারবে, আর বল চলে যাবে মাথার উপরের আর্চ দিয়ে। ভাল না? ‘ ঘন্টুদা বলল, ‘টুবাই পেলে শেষ কবে দৌড়ে এসে বল মেরেছে জানিস? তোর জন্মের পর অন্ততঃ নয়। সেই পেলেকে এই বয়সে আবার দৌড় করাবি? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না!’ টুবাই একটু ঘাবড়ে গেলেও উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘ কেন এই কলকাতা শহর তো দেখেছে পেলের খেলা। মোহনবাগানের সঙ্গে, ৭৭ এ যখন এসেছিল?’ ঘোরতর ইস্টবেঙ্গল সমর্থক কেষ্টদা পাশ থেকে ফুট কাটল ‘ বাপ কাকার থেকে শুনে বেশি কপচিও না, ওটা পেলে নয়, শান্তিগোপাল ছিল’। টুবাই ফায়ার, ‘বাজে না বোকে চায়ে মন দাও।’ ঘন্টুদা বলল, ‘ তা সেই ঘি এখনও শোকাবি?’
টুবাই সঙ্গে সঙ্গে বুক চিতিয়ে বীরদর্পে বলতে লাগল ‘ কী বলছ ঘন্টু দা, আমাদের মতো একটা ফুটবল লাভিং নেশন আমরা সে’দিনটা নিয়ে গর্ব করব না?’
এ’বার ঘন্টুদা’র কোর্টে বল। রীতিমতো দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘ কত দিন আর ফুটবল লাভিং নেশন হয়ে থাকবি? ৭৭ থেকে ২০১৫ কত বছর হয় বল তো ? ৩৮ বছর। এই ৩ দশকে কী বদলাল দেশের ফুটবলে? পিছতে পিছতে এখন ১৬৭। পেলে বুড়ো হয়ে গেল। ৩৮ বছর আগে পেলে ঘুরে যাওয়ার পর কোন বিপ্লব হল শুনি ভারতীয় ফুটবলে? এই ক’বছর আগে মারাদোনা এল, দু’বছর আগে এই পুজোর সময়ই তো দুঙ্গা এল, কী হল তাতে? কটা বিশ্বকাপ খেললি তোরা?’
আমি দেশের স্বার্থে এবার মুখ খুললাম, ‘কেন, ২০১৭ এ আণ্ডার ১৭ বিশ্বকাপ খেলব তো।’
ঘন্টুদা আরও ক্ষেপে গিয়ে বলল ‘সেটা কি পেলে মারাদোনার আসার দৌলতে না তোদের ফুটবলের উন্নতির দৌলতে ? ১৬৭ নম্বর দেশে কখন আর কেন বিশ্বকাপ দেয় ফিফা জানিস না? বাকি সবটাও সেই জন্যই।’ ‘ আসল সমস্যাটা কোথায় জানিস? এই পুজোর ফিতে কাটা, বা ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুরে ফ্ল্যাট বেচা, এর বাইরে এই মহান মানুষগুলকে কাজে লাগাবার কথা কেউ ভাবলই না এ’দেশে। তাই তো সারাজীবন আমরা অহঙ্কারি সমর্থক। বিশ্বকাপে অন্যের দেশের পতাকা ঝোলাব, পেলে মারাদোনা নিয়ে রকের আড্ডায় বাইসাইকেল কিক হাকাবো। সত্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে বিদেশিদের নিয়ে মেতে থাকব। নিজেদের ১২ ধাপ পিছিয়ে ১৬৭ নম্বরে পৌঁছে যাওয়ার মতো সিরিয়াস সমস্যাকে লুকিয়ে ফেলবো পেলের জমকাল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান দিয়ে। তোরাও মেতে থাকবি এই নিয়ে। ও’দিকে যে সব গিয়ে ক্রমশই হাতে থাকছে শুধু চামচ, তা বুঝবি না। গেটে আর্চ দিয়ে আলোর ঝর্ণায় গোল দেওয়াবি ফুটবল আইকন দিয়ে, আর নিজের দেশে ম্যাচের ফাঁকে আলো নিভে মুখ পুড়বে বিদেশি টিমের সামনে।’ বলেই কেমন যেন মনমরা হয়ে দমে গেল ঘন্টুদা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আমারও। সত্যি বলতে কি খবরটা আমিও পেপারে দেখেছিলাম। তবে বাকি খবরগুলর মধ্যে খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি আসলে। আলাদা করে কিছু মনে হয় না আর এই খবরটা দেখলে। ঘন্টুদা’র সামনে আর বলার সাহস হয়নি, এখানে স্বীকার করছি। আর্জেন্টিনার ভক্ত তো, তাই মেসি’র দেশ ফিফা র্য্যা ঙ্কিং-এ সবার উপরে দেখে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। ভারতেরটা মাথায় ছিল না। এখন না বড় অপরাধী বোধ হচ্ছে, জানেন!