স্বরূপ গোস্বামী
আজকেই ঘটতে চলেছে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ইস্টবেঙ্গল খেলতে নামবে মুম্বই এফ সি-র বিরুদ্ধে। কিন্তু মাঠে থাকবেন না কোনও দর্শক। হয়ত ভাবছেন, সবাই পুরভোট নিয়ে ব্যস্ত। তাই হয়ত খেলা দেখতে আসতে পারবেন না। আসলে, তা নয়। রাজ্য পুলিশের ফতোয়া, মাঠে কোনও দর্শক থাকা চলবে না।
শুধু আজকের ম্যাচে নয়। আগামী ২৫ এপ্রিল আই লিগের আরও একটা ম্যাচ। ২৮ এপ্রিল এএফসি কাপের ম্যাচ। ওই দুই ম্যাচেও কোনও দর্শক থাকা চলবে না। কলকাতার ফুটবলে তো দূরের কথা, এতবছরের ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসেও এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি।
এমন এক আজব ফতোয়া। অথচ, কলকাতার দুই বড় ক্লাব কী অদ্ভুত নীরবতায় সবকিছু মেনে নিল! আঘাতটা শুধু ইস্টবেঙ্গলের উপর এল, এমন নয়। কয়েকদিন আগের কথা। আই লিগের সূচি অনেক আগে থেকে তৈরি। হঠাৎ, সরকার বাহাদুর জানিয়ে দিল, মোহনবাগানের সামনের দুটি ম্যাচ যুবভারতীতে হবে না। তাদের যদি খেলতেই হয়, অন্য মাঠে খেলতে হবে। কারণ, যুবভারতীতে আই পি এলের উদ্বোধন হবে। ভাবা যায়, কী অরাজকতা চলছে!
আগামীদিনে ফুটবলকর্তারা যদি ইডেনে আই লিগের বা সন্তোষ ট্রফির উদ্বোধন করতে চান, সরকার রাজি হবে ? কী অদ্ভুত আবদার চিন্তা করুন। ইডেনে অনুষ্ঠান করলে মাঠের ক্ষতি হবে। তাই সেখানে নাচন-কোঁদনের অনুষ্ঠান করা যাবে না। করতে হবে যুবভারতীতে। তাও আবার নির্ধারিত সূচির ম্যাচ বাতিল করে। খেলা নেই, তেমন সময় অনুষ্ঠান হলে তেমন আপত্তির কিছু নেই। তাই বলে খেলা বাতিল করে নাচগানের অনুষ্ঠান করতে হবে ? মোহনবাগানের একজন কর্তাও প্রতিবাদ করে বিবৃতি পর্যন্ত দিতে পারলেন না! জাতীয় ক্লাবের কর্তারা এতটাই মেরুদন্ডহীন হয়ে গেলেন!
সেদিন মুখ টিপে হেঁসেছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা। ঘুটে পুড়লে গোবর হাসে। কিন্তু আজ তাকেও সেই এক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হল। আজ জিতলে আই লিগে ২০০ ম্যাচ জেতা হবে ইস্টবেঙ্গলের। আজ একটি গোল করলে রন্টি মার্টিনের ২০০ গোল হবে। কিন্তু গ্যালারিতে হাততালি দেওয়ার কেউ থাকবে না।
সরকারের যুক্তি, পুলিশ পাওয়া যাবে না। এই ম্যাচে কী এমন পুলিশ লাগত! একশো পুলিশ দিলেই হয়ত কাজ হয়ে যেত। গ্যালারির অন্য গেট গুলো বন্ধ হলে দুটো দিক খুলে রাখলেই হত। বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী ভাড়া করে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবই সামলে দিতে পারত। কিন্তু না, সরকার বলেছে। অতএব, আর কোনও যুক্তি দেখানো যাবে না। যদি ‘তিনি’ রেগে যান!
পুরভোটের দিন মাঝদুপুরে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, পুলিশ থেকেই বা কী করত ? পুরভোটে পুলিশের ভূমিকা কতটা ন্যক্কারজনক হতে পারে, তা প্রতিটি ওয়ার্ডে বোঝা গেল। পুলিশের কাজই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে, শাসকদলের গুন্ডামিকে সুনিশ্চিত করা, আর গুন্ডাদের আড়াল করা। একটা ক্ষেত্রে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিতে পেরেছে ? গতকাল রাতে, কান্তি গাঙ্গুলি প্রতিবন্ধী স্কুলে। কোনও প্ররোচনা ছাড়াই হঠাৎ সেখানে গুন্ডাবাহিনী হাজির হয়ে কান্তি গাঙ্গুলির মতো বর্ষীয়াণ নেতাকে মারধর করল। কারা সেই আক্রমণকারি, সবাই জানে। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিতে পেরেছে ? এমন মেরুদন্ডহীন পুলিশ শুধু গুন্ডাদেরই ভরসা বাড়ায়।
সরকারের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। যেখানে গুন্ডা, মস্তান আছে, সেখানে তাদের আড়াল করার জন্য বা উৎসাহিত করার জন্য পুলিশ লাগবে। যেখানে গুন্ডামি হয় না, যেখানে অশ্লীল নাচন কোঁদন হয় না, যেখানে পবিত্র আবেগ নিয়ে মানুষ খেলা দেখতে যায়, সেখানে পুলিশ থাকবে কেন ?
এক বড় ক্লাব লিগ তালিকার শীর্ষে। অনকদিন পর আই লিগ আসার মতো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আরেক বড় ক্লাব শুরুতে একটু পিছিয়ে পড়লেও আবার নিজের হারানো ছন্দ ফিরে পেয়েছে। মাঠের মধ্যে ফুটবলাররা তো তবু লড়াই করছেন। কিন্তু মাঠের বাইরের কর্তারা ! এই ব্যাপারে দুই প্রধানের খুব একটা ফারাক নেই। মোহনবাগানে কাল দুই শিবিরের নির্বাচনী প্যানেল বেরোবে। যতদূর শোনা যাচ্ছে, শাসকদের প্যানেলে নাম থাকবে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই বাবুন ব্যানার্জির। ভাবতে অবাক লাগে, মোহনবাগান নির্বাচন নিয়ে কর্তারা বৈঠক করছেন নবান্নে, মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। কোনও শিবিরই বোধ হয় নিজেদের পছন্দমতো প্যানেল করতে পারবে না। তাকিয়ে থাকতে হবে সেই কালীঘাট বা নবান্নের দিকে।
এখানে এক মন্ত্রী জেলে গেলে, সব খেলোয়াড়দের রাস্তায় নেমে মিছল করতে হয়। সেই মিছিলে হাঁটলে খেলরত্ন, ক্রীড়াসম্মান এসব দেওয়া হয়। সেই মিটিংয়ে না গেলে, দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। রাজ্যে এক করিৎকর্মা মন্ত্রী আছেন। তাঁর এতদিন একটাই কাজ ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর মিটিং হলে সিনেমা আর্টিস্ট, সিরিয়াল আর্টিস্ট সাপ্লাই দিতে হবে। না এলে তাদের কী দশা হবে, তা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কান পাতলেই শোনা যায়। এবার তিনি আবার ক্রীড়া দপ্তরের দায়িত্বে। এখন খেলার মাঠকেও কুক্ষিগত করতে চাইছেন। ভাবতে অবাক লাগে, তিনি মোহনবাগানের অন্যতম কর্তা। অথচ, তিনিই আই পি এলের উদ্বোধনের জন্য মোহনবাগানকে যুবভারতী-ছাড়া করছেন। মোহনবাগান কর্তা হিসেবে তাঁর বক্তব্য কী, জানতে খুব ইচ্ছে করে। এবার তাঁর আমলেই ঘটছে আরও একটি মহান ঘটনা। দর্শকবিহীন ফুটবল।
খেলা যদি দর্শকছাড়া হতে পারে, তাহলে অন্যকিছুও তো হতে পারে। যুবভারতীতে শাহরুখ নাচ করবেন। কিন্তু দর্শক থাকবে না, এমনটা হলে কেমন হয় !
বা, ধরা যাক, ব্রিগেডে বিরাট মঞ্চ হল। দেবের পাগলু ড্যান্স হল। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ হল। কিন্তু কোনও দর্শক রইল না। কেমন হয় ? করিৎকর্মা ক্রীড়ামন্ত্রী বা মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী একবার ভেবে দেখতে পারেন।