নিন্দুকেরা বলছে, দিদি নাকি মুষড়ে পড়েছেন। সু্প্রিম কোর্টের রায়ের পর নিজের ছবি ছাপতে পারবেন না। কে বলল পারবেন না ? নানা উপায় আছে। চুপি চুপি মুখ্যমন্ত্রীকে সেই উপায় বাতলে দিলেন রবি কর।।
এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন না দিদি। ও দিদি, আপনার পায়ে পড়ি। বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করার এতবড় সুযোগটাকে নষ্ট হতে দেবেন না।
একেই তো বাঙালির শত্রুর অভাব নেই। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম- সারা ভারত আছোলা বাঁশ নিয়ে সদা সর্বদা বাঙালির পিছনে উদ্যত হয়ে আছে। নেতাজির ফাইল গোপন করে রাখছে। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দিচ্ছে না। সৌরভকে টিম থেকে বাদ দিচ্ছে। মদন মিত্রকে জেলে ঢোকাচ্ছে। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে বাজে রেফারিং হচ্ছে — । এখন আবার এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
দেশজুড়ে হাজার হাজার মামলা বকেয়া। সেদিকে মন নেই। রায় দিল, সরকারি বিজ্ঞাপনে কোনও নেতা মন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করা যাবে না। সারা দেশের জন্যই রায়টা দিল বটে। কিন্তু আমরা কি বুঝি না, রায়ের আসল লক্ষ্য কে! আমরা কি বুঝি না, এই রায়ের আসল উদ্দেশ্য হল, দিদিমণির ছবি ছাপানো বন্ধ করা! আমরা কি বুঝি না, সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস- সবাই একজোট হয়ে মা মাটি মানুষের উপর এই নির্মম আঘাত হেনেছে ?
আমরা সব বুঝি। সরকারি বিজ্ঞাপনে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ছাপানো হবে না, তাই উনপাঁজুরে বিরোধীগুলো বগল বাজিয়ে নাচছে। কেন রে, কেন ? মুখ্যমন্ত্রী কি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ? তোর, আমার, আমার বাবার—সবার দিদি নন ? তোরা তোদের ফ্যামিলি অ্যালবামে নিজের দিদির ছবি রাখিস না ? তাহলে, বিজ্ঞাপনে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ছাপলে তোদের গা জ্বলে কেন ? তাছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী জেলায় জেলায় গিয়ে, মুরগির ছানা বিতরণ, মৎস্যজীবীদের জাল বিতরণ, ঘোষপাড়া থেকে মণ্ডলপাড়া অব্দি সুরকির রাস্তা নির্মাণ, তেলিপাড়ার ডোবা সংস্কার, সুলভ শৌচালয়ের উদ্বোধন- এসব কর্মযজ্ঞ করেন। তাঁর বিজ্ঞাপনে ছবি দিতে হবে না ? এত কাজ ভূভারতে আর কে করেন ? তোরা ৩৪ বছরে কাজ করিসনি, তাই তোদের ছবি ছাপা হয় না। অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা কাজ করে না। তাই ছবি ছাপানোর সাহস পায় না।
এরই মাঝে শুনলাম, দিদির দলের লোকজন তোড়জোড় করছে, যাতে এই রায়কে ঠেকানো যায়। যাতে সরকারি বিজ্ঞাপনে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করা যায়। লোকসভায় এই নিয়ে চিৎকার করলে, অনেকেই হয়ত সমর্থন করে দেবে। দিদির এমপি-রা শুনছি নাকি সেই চেষ্টাই করবেন।
কিন্তু দিদি, আমার কথা শুনুন। এই রায় যেমন আছে, তেমন থাকতে দিন। একবার মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ছাপানোর অনুমতি পাওয়া গেলে সব রাজ্যের সব মুখ্যমন্ত্রী নিজের নিজের ছবি ছাপাতে শুরু করবে। যে ছাপাতো না, সেও ছাপাতে ছাপাতে হেদিয়ে পড়বে। সবাই যা করে, আপনিও যদি তাই করেন, তাহলে আপনার মর্যাদা কোথায় থাকবে ? ভাবুন তো, জয়ললিতা, মায়াবতী, বসুন্ধরা রাজে, সবাই যদি হাওয়াই চটি পরে,তাহলে হাওয়াই চটির ইজ্জত কোথায় থাকে!
তাই দিদি, ছোট ভাইয়ের মিনতি শুনুন। প্রতিকূল পরিস্থিতি তো জীবনে আসেই। যিনি বীর, তিনি সেই পরিস্থিতিকেই নিজের পক্ষে টেনে আনেন। আপনি এমন কাণ্ড করুন, যাতে আদালতের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যায়। আদালত তো ছবি, মানে ফটোগ্রাফ ছাপাতে নিষেধ করেছে। আঁকা ছবি ছাপতে তো মানা করেনি। যোগেনদা আর শুভাদাকে দিয়ে আঁকান আপনার পোট্রেট আর ছাপান কাগজে কাগজে। টিভির বিজ্ঞাপনে আপনি নিজে যাবেন না। আপনার ভূমিকায় অপরাজিতা আঢ্য কিংবা বাহামণি। অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মুখে মাছি ঢুকে যাবে। তাঁদের হাতে আছে এমন শিল্পী, এমন অভিনেত্রী !
তবে হ্যাঁ, আমাদের রাজ্য তো গরিব। আমরা তো কেন্দ্রের বঞ্চনার শিকার। অন্য রাজ্যগুলোর তো অনেক পয়সা। তারা হয়ত টাকা ছড়িয়ে পেশাদার শিল্পীদের নিয়ে নিজেদের ছবি আঁকাবে। তাই দিদি, আমার মাথায় আরও ভাল একটা প্ল্যান এসেছে। অন্য কারও আঁকার দরকার নেই। আপনি নিজেই ছবি আঁকুন। কারখানার উদ্বোধন ? আপনি শ্রমিকভাইদের ছবি আঁকলেন। সেতু উদ্বোধন ? আপনি যানবাহনের ছবি আঁকলেন। নির্মল বাংলা দিবস ? আপনি শৌচকর্মের ছবি আঁকলেন। তলায় লিখে দিলেন শিল্পী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফটো ছাপতে মানা, নাম লিখতে তো মানা নেই।
কী রে বুদ্ধ, কী রে মানিক সরকার, কী রে নীতীশ কুমার, তোদের ক্ষমতা আছে এমন ছবি আঁকার ? মিঠুন চক্রবর্তীর এক ছোবলেই ছবি। দিদিমণির তিন আঁচড়েই ছবি। তার দাম কোটি কোটি টাকা। দিদিমণি তোদের মতো গুণহীন বেগুন নাকি ?
বলছিলাম কী দিদি, আপনি কত বড় শিল্পী সে তো আমরা জানি, আর সুদীপ্ত সেন জানে। কিন্তু সুদীপ্তটা জেলে যাওয়ার পর আপনি ছবি আঁকা একেবারেই বন্ধ করে দিলেন। তা, এখন তো সিবিআই অনেকটাই পথে এসেছে। এই তালে, জয় মা বলে আবার শুরু করে দিন। ছবিগুলো বিজ্ঞাপনের ব্যবহার হবে। আবার পরে সেই ছবির প্রদর্শনীও হবে। দেখবেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাই লাইন দিয়ে সেই ছবির প্রদর্শনী দেখছেন। গ্লোবাল টেন্ডার ডেকে সেই ছবির নিলামও করতে পারেন। পৃথিবীর নানা প্রান্তে কত সুদীপ্ত ছড়িয়ে আছে, কে বলতে পারে! ছবি বিক্রির টাকা কিছুটা পার্টি ফান্ডে যাবে। বাকিটা যাবে ক্লাবে ক্লাবে। ক্লাবগুলোকে বলব, তোরা তো সরকার নোস, তোরা দিদিমণির ছবি ছাপা। বিচারপতিরা যে কাগজ পড়ে, সেই কাগজে বেশি করে ছাপা। বিচারপতিরা দেখবেন আর জ্বলবেন, লুচির মতো ফুলবেন।
শুধু কি ছবি ? বিজ্ঞাপনে আপনার কবিতাও জুড়ে দিন দিদি। ধরুন পরিবেশ দূষণের বিজ্ঞাপন। আপনার সেই বিখ্যাত কবিতা ছাপা হলঃ
বসন্তের বর্ণে দীর্ঘশ্বাস
মুমুর্ষু বর্ণের ফুল বাগিচা
ঘন অরণ্যে আগুনের ছাই
জ্বলনে বিধ্বস্থ করমচা ।।
ওহ, ওহ, ফাটাফাটি, ফাটাফাটি।
ধরুন, হজ যাত্রীদের শুভেচ্ছা জানানো হবে। বিজ্ঞাপনে লেখা হল আপনার সেই অমরত্ব পাওয়া কবিতাঃ
‘‘অর্থবল আর পেশীবলের জন্য
সত্য খায় ধাক্কা
সত্যের জন্য তবু লড়তে হবে
মদিনা থেকে মক্কা।।’’
(হয়ত অনকে কবিতাগুলো শোনেনি। তাই তো বলি, পার্থদাকে বলে এগুলো সিলেবাসে ঢুকিয়ে দিন। তাহলে কচিকাচাদের মুখে মুখে ফিরবে। বাচ্চারা জানলে, তাদের মায়েরাও জানবে।)
পায়ের ধুলো দিন, দিদি। পায়ের ধুলো দিন। সেই সম্রাট হর্ষবর্ধনের পরে ভারতের আর কোনও শাসক এমন সাহিত্য চর্চা করেনি। আপনি আঁকুন, লিখুন, ছাপুন। বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করুন। বাংলার আকাশে পুণ উদিবে সুদিন, ওই দেখ প্রভাত উদয়।
হঠাৎ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে গেল। ভারি রসিক মানুষ ছিলেন। শ্যামবাজারের মোড়ে নেতাজির মূর্তি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘ওটা নেতাজির মূর্তি কেন হবে ? ওটা একটা ঘোড়ার মূর্তি। ঘোড়ার পিঠে একটা লোক চেপে আছে। কেউ কেউ বলে, সেই লোকটা নাকি নেতাজির মতো দেখতে।’
এই গল্পটা কেন বললুম, বলুন তো ! মোদি এখান-ওখানে গিয়ে মনের সুখে সেলফি তুলে বেড়াচ্ছে। তাকে টেক্কা দিতে আপনি এক কাজ করুন। নিজেই নিজের পোট্রেট আঁকুন। নাম হোক, ‘স্ব-চিত্র’। তারপর ছাপুন সব কাগজে, হোর্ডিংয়ে। যদি কেউ মামলা করে, তখন আপনার অফিসাররা ওই সন্দীপনবাবুর মতো বলে দেবে, ‘ওটা তো মুখ্যমন্ত্রীর ছবি নয়। ওটা এক মহামানবীর ছবি। ঘটনাচক্রে সেই মহামানবীর মুখের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কিছুটা মিল আছে।’ ব্যাস, বিচারপতির আর কিছুই করার থাকবে না। আইনটা কি শুধু ওরা একাই জানে! আপনি বুঝি জানেন না!
হেঁ হেঁ, তখন আদালত কী করবে ? ওই যে একটা গান আছে না ! বিচারপতি তোমার বিচার করল যারা, আজ জেগেছে সেই মমতা। কী বললেন, মমতা নয়, ওটা জনতা হবে ! ধুর, তাহলে গানটা বাজে। মমতা হলে কেমন জুতসই হত। যাই হোক, দিদি আপনি একটা জুতসই গান লিখে ফেলুন তো, সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য। নচিকেতা আর কবীর সুমন একসঙ্গে গাইবে। হ্যাঁ হ্যাঁ, গাইবে। আপনি বললেই গাইবে। যদি হিট না হয়, একমাস পর ইন্দ্রনীল রিমেক করবে। ও নিজের গানটা গাইতে পারে না, লোকের গানটা কিন্তু ভালই গায়।
চল রে চল সবে মা মাটি মানুষ
দিদিমণি ওড়াচ্ছে ফানুস।
গানে যেন মমতা, দিদিমণি, সততার প্রতীক, এই কথাগুলো বারবার থাকে। আদালত কিচ্ছু বলতে পারবে না। ছবিতে নিষেধাজ্ঞা আছে, গানে তো নেই। আর থাকলেই বা। সব আদালতের থেকে বড় জনতার আদালত। তার থেকে বড় মমতার আদালত।
অর্ডার, অর্ডার।