রক্তিম মিত্র
আবার তিনি গর্জে উঠেছেন। কখনও পার্টি অফিসের অনুষ্ঠানে। কখনও সাংবাদিক সম্মেলনে। তিনি, অর্থাৎ দেবব্রত বিশ্বাস।
মুশকিলটা হল, এই নামটা বললেই এক প্রতিবাদী গায়কের কথা মনে পড়ে যায়। যিনি চিরকাল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেলেন। বিশ্বভারতী রেকর্ড করতে দিচ্ছে না, ভাঙা শরীর নিয়ে মাঠে ঘাটে রবি ঠাকুরের গান গেয়ে বেড়ালেন।
কিন্তু এই দেবব্রত বিশ্বাস কে, তা এই রাজ্যে কজন চেনেন, সন্দেহ আছে। যাঁরা ফরওয়ার্ড ব্লক করেন, তাঁরা চেনেন। এর বাইরে বাকিদের কোনও আগ্রহ নেই তাঁকে ঘিরে। মাঝে মাঝে সিপিএম বিরোধী মন্তব্য করে একটু প্রচার পান। যেটুকু পরিচিতি, তা ওই কারণেই। তাঁকে মনে রাখার অন্য কোনও ইতিবাচক কারণ নেই।
শরিক দলের নেতারা সিপিএম বিরোধী কথা বললে চিরকালই ভাল প্রচার পান। এক সময় যতীন চক্রবর্তী পেয়েছেন। কখনও দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও ক্ষিতি গোস্বামী, কখনও অশোক ঘোষ, কখনও নন্দগোপাল ভট্টাচার্য। এঁদের তবু কিছুটা অবদান আছে, আত্মত্যাগ আছে। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাস নিজের দলেও একেবারেই গ্রহণযোগ্য নন। অশোক ঘোষ ছিলেন বলেই তিনি রাজ্যসভার এমপি হয়েছিলেন। অশোক ঘোষ ছিলেন বলেই তিনি এখনও কেন্দ্রীয় সম্পাদক আছেন। আর কেন্দ্রীয় সম্পাদক থাকলে যেটুকু পরিচিতি না থাকলেই নয়, সেটুকুই আছে।
নির্বাচনে বামেরা হারার পর আবার তিনি আসরে নেমে পড়েছেন। সিপিএম-কে গালমন্দ করতে লেগেছেন। যেন তাঁর কথা শুনলেই বামফ্রন্ট ড্যাং ড্যাং করে জিতে যেত। নিন্দুকেরা বলছেন, এবার আর কোনওভাবেই তিনি কেন্দ্রীয় সম্পাদক থাকতে পারবেন না। সেটা বুঝতে পেরেই এবার তিনি রাজ্য সম্পাদক হতে চাইছেন।
ভেবে দেখুন, একজন প্রধানমন্ত্রী যদি মুখ্যমন্ত্রী হতে চান, কেমন লাগবে ? একজন রাষ্ট্রপতি যদি অবসরের পর রাজ্যপাল হতে চান, কেমন লাগবে ? তাঁর ক্ষেত্রেও অনেকটা সেইরকম। আছেন কেন্দ্রীয় সম্পাদক। এবার হতে চাইছেন রাজ্য সম্পাদক। এটা একমাত্র তিনিই পারেন। বাম রাজনীতিতে এরকম নজির কি আছে ? জানা নেই।
কী কারণে তাঁকে মনে রাখবেন ? ১) অশোক ঘোষ সারাজীবন নিজে বিধায়ক বা সাংসদ হওয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। সেটাই তাঁর মূল পরিচয়। এবং সাংসদ থাকার জন্য কতটা নিচে নেমেছেন, তা অনেকেই জানেন। তিনি যখন সংসদীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন মানতে কষ্টই হয়
২) সাংসদ হিসেবে রাজ্যসভায় কতটুকু ছাপ ফেলেছেন ? সেরা সাংসদদের তালিকায় নাম থাকা তো দূরের কথা, মোটামুটি চলনসইয়ের দলেও ফেলা যাবে না।
৩) খুব অনাড়ম্বর জীবন ? একেবারেই না। আর্থিকভাবে সৎ? অতিবড় গুণমুগ্ধরাও বোধ হয় এমন দাবি করবেন না।
৪) দলের ভেতর দারুণ জনপ্রিয় ? গ্রহণযোগ্য ? তাও বলা যাবে না। মাথার উপর অশোক ঘোষের হাত ছিল। তাই কেউ কিছু বলতে পারতেন না। গোপন ব্যালটে ভোট হলে দলের তিরিশ শতাংশ কর্মী বা নেতার ভোটও পাবেন না।
৫) দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক আবহ পছন্দ করেন ? বরং উল্টোটাই বলা যায়। সবার কাজি নাক গলান। কথায় কথায় অন্যদের ছোট করেন। তাঁর কথাই শেষ কথা। এরকম একটা হাবভাব করেন।
৬) দারুণ বক্তা? শোনা যায়, তিনি বলতে উঠলেই হল খালি হয়ে যায়। কারণ, এমন সব অবান্তর কথা বলে যান, কর্মীদের কাছে যা ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।
৭) দারুণ সংগঠক ? শোনা যায়, তিনি যে জেলায় যান, নতুন নতুন ঝগড়া বাঁধিয়ে আসেন। নতুন গোষ্ঠী তৈরি করে আসেন। একজন সর্বভারতীয় সম্পাদক জেলায় গিয়ে গোষ্ঠীবাজি করছেন। কিন্তু তিনি সব জেলায় নিজের গোষ্ঠী তৈরি করেছেন।
৮) ধরা যাক এবার বিধানসভা নির্বাচন। অশোক ঘোষ মারা গেলেন। কে কোথায় প্রার্থী হবেন, কোথায় আলোচনা হয়েছে ? রাজ্য কমিটির কোনও সভা হয়েছে ? দু-তিন জন নেতা যাঁকে খুশি প্রার্থী করেছেন। কে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা দেখা হয়নি। কে কত টাকা দিতে পারবেন, কে কত টাকা খরচ করতে পারবেন, সেটাই ছিল মানদন্ড। এমন ভাবনা নিয়ে যাঁরা প্রার্থী বাছেন, তাঁদের যা হওয়ার, তাই হয়েছে।
তাহলে কোন গুণটার জন্য মনে রাখবেন দেবব্রত বিশ্বাসকে ?
অশোক ঘোষের শূন্য আসনে তিনি ? না, মানা যাচ্ছে না।