রাহুল বিশ্বাস
ভারত থেকে লুঠ করা টাকা তছনচ করেছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। সোজা কথায়, চোরাই মালের একটা অংশ আত্মসাৎ করেছিলেন। তাই নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তদন্ত হয়। জেরায় জেরায় জেরবার ক্লাইভ বলেছিলেন, আমি যা করেছি, দেশের জন্য করেছি। এই কথা শুনে দার্শনিক স্যামুয়েল জনসন বলেছিলেন, ‘প্যাট্রিয়েটিসম ইস দ্য লাস্ট রিফিউজ অফ দ্য স্কাউন্ড্রেল।’ অর্থাৎ, স্কাউন্ড্রেলদের যখন কিছুই বলার থাকে না, তখন তারা দেশপ্রেমের বুলি আওড়ায়। কোণঠাসা হয়ে পড়লেই তারা দেশপ্রেমের আশ্রয় নেয়।
ভারতে ইদানীং দেশপ্রেম খুব বেড়ে গেছে। দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষকে ভালবাসা নয়। দেশপ্রেম মানে পাকিস্তানকে মার দেওয়া। ইসরো কিছুদিন আগে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করল। তা নিয়ে দেশপ্রেম জাগল না। জাগল সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে।
সার্জিক্যাল স্ট্রাইক খুবই উচিত কাজ, এব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যে স্কাউন্ড্রেলরা এতকাল কোণঠাসা হয়েছিল এখন তারা সার্জিকাল স্ট্রাইককে লাস্ট রিফিউজ মানে শেষ আশ্রয়স্থল বানিয়ে ফেলেছে। অন্য কোনও যুক্তিতে এঁটে না উঠেছে, দেশপ্রেম দেশপ্রেম নিয়ে চিৎকার চলছে। যাতে দেশের অন্য সব সমস্যা চাপা পড়ে যায়।
দেশজুড়ে দলিতদের উপর আক্রমণ, গোরক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব, উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘু হত্যা, গুজরাটে দরিদ্রের উপর হামলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলা- সবকিছুই চাপা পড়ে যাচ্ছে এই সার্জিকাল স্ট্রাইকের আওয়াজে। ঠিক যেমন রবার্ট ক্লাইভ দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলে সব দুর্নীতিকে চাপা দিতে চেয়েছিলেন।
সার্জিকাল স্ট্রাইক যদি সরকারের সাফল্য হয়, তাহলে একের পর এক সেনাঘাঁটিতে হামলা কাদের ব্যর্থতা ? কাদের ব্যর্থতায় কাশ্মীর আবার অশান্ত হল ? এ সব প্রশ্ন চাপা পড়ে যাচ্ছে ‘দেশপ্রেমী’দের চিৎকারে।
আসলে, আমাদের দেশে দেশপ্রেমী হওয়া খুব সোজা। মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর দরকার নেই। শুধু পাকিস্তানকে গাল পাড়লেই দেশপ্রেমী হওয়া যায়। যদি বলা হয় সীমান্তে সেনারা যেমন লড়াই করছে করুক, আসুন আমরা নিজেরাও কিছু লড়াই করি। পাশের বাড়িতে বধূ নির্যাতন হলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, বেআইনি পুকুর ভরাট হলে সোচ্চার হই, কাউন্সিলর তোলাবাজি করলে রাস্তায় চিৎকার করি, গাছ কাটা হলে প্রতিবাদ করি। এই সব কাজ করতে বললেই দেখবেন অধিকাংশ দেশপ্রেমী ভেগে যাবেন। আমাদের দেশপ্রেম শুধু ফেসবুকে। নিজেরা সেনাবাহিনীতে যোগ দেব না, শুধু গ্যালারিতে বসে হাততালি দেব। রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, কিছুই না বুঝে পাকিস্তানকে মারতে হবে বলে স্লোগান তুলব। আর যারা এই যুদ্ধ যুদ্ধ জিগিরের বিরোধীতা করবে, তাদের দেশদ্রোহী বলে গাল পাড়ব। এটাই আমাদের দেশপ্রেম। দেখেশুনে মনে হয়, স্যামুয়েল জনসনের কথাটা সর্বদেশেই সত্যি। প্যাট্রিয়টিজম ইজ দ্য লাস্ট রিফিউজ অফ দ্য স্কাউন্ড্রেল।
(জানি, এই লেখাটা পড়ে প্রচুর লোক আমাকেও দেশদ্রোহী বলে গাল পাড়বেন। )।