ধীমান সাহা
নার্সিংহোম নিয়ে আমাদের সবারই কম–বেশি তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। মুখ্যমন্ত্রী টাউন হলে যা যা বলেছেন, হয়ত মিথ্যে নয়। আমাদের অভিজ্ঞতাও তো একইরকম। সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ আনতে চায়, আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু এর পেছনে সদিচ্ছা কতটা, আর লোকদেখানো ব্যাপার কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
ধরা যাক, মোদি রাষ্ট্রসঙ্ঘে হিন্দিতে ভাষণ দিচ্ছেন। দেখে আপনার ভাল লাগতেই পারে। কিন্তু সেখানকার দর্শক বা স্রোতা কারা? বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তাঁরা কজন হিন্দি বোঝেন? ইংরাজিতে বললে অনেক বেশি দেশের প্রতিনিধিরা বুঝতে পারতেন। ভারতের অনুকূলে একটা বিশ্বজনমত তৈরি হতে পারত। কিন্তু না। কিন্তু মোদি বাবু তাঁদের কথা ভেবে বলেন না। বলেন নিজের দেশের লোককে শোনাতে। তিনি জানেন, টিভিতে এই ভাষণ দেখানো হবে। অতএব, হিন্দিতে বলো। সেখানে সদিচ্ছার থেকেও লোক দেখানো ব্যাপারটা বেশি করে এসে যায়।
উদাহরণটা দিলাম বোঝার সুবিধার জন্য। এক্ষেত্রেও লোক দেখানো তাগিদটাই বেশি। কখন নার্সিংহোমের মালিকদের ডাকা হল? যখন আলিপুরে একটি বিখ্যাত নার্সিংহোমে ভাঙচুর চালানো হল। রোগীর আত্মীয়দের নামে চালানো হলেও আদৌ কজন রোগীর আত্মীয়, তা নিয়ে সত্যিই সংশয় আছে। সহজ কথা, গুন্ডামি। একে জনরোষ বলে আড়াল করার কোনও মানে হয় না। এসব ঘটনা এই বাংলায় আর নতুন নয়। যে যেখানে খুশি, ভাঙচুর চালাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাসকদলেরই একটি অংশ যুক্ত থাকছে। অথচ, ঘটনার পর তিনি বললেন, আমি নার্সিংহোমগুলোকে ডাকব। যেন এক্ষেত্রেও নার্সিংহোমগুলোই দায়ী।
মানছি, নার্সিংহোমগুলো অনেকসময়ই রোগী ও তার পরিবারকে অহেতুক হয়রান করে। মোটা অঙ্কের বিল চাপিয়ে দেয়। তাই বলে ভাঙচুর কোনও সমাধান নয়। ধমক দেওয়া হল কাদের? যারা আক্রান্ত, তাদের। সেই বৈঠক লাইভ দেখানো হল। তার মানে, গোটা রাজ্যকে তিনি দেখাতে চাইলেন, দেখো আমি ওদের কেমন ধমক দিচ্ছি। একটি হাসপাতালের ত্রুটি বুঝতে গেলে যতখানি জ্ঞান ও বিদ্যেবুদ্ধি থাকতে হয়, মাননীয়ার তা নেই। তাই সস্তায় বাজিমাত করা কিছু কথা বলে গেলেন। হোমওয়ার্ক নিতান্তই দায়সারা।
সারা রাজ্য দেখল, বিভিন্ন নার্সিংহোমের কর্তারা কার্যত হাতজোড় করে বলছেন, আপনি যা বলবেন, তাই করব ম্যাডাম। কেউ বললেন, সবসময় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে চলব। কেউ বললেন, আপনি যেভাবে উন্নয়ন করছেন, আমরাও সেই উন্নয়নের কাজে সামিল হব। নার্সিংহোমের এই মুচলেকা দেখল সারা রাজ্য। পাড়ার মোড় থেকে চায়ের দোকান, আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে— দেখেছো, কেমন দাবড়ানি দিল! এর আগে কেউ এমনটা করতে পেরেছে? জ্যোতিবাবু পেরেছে? বুদ্ধবাবু পেরেছে? আপাতত এই প্রশ্নগুলো ঘোরাঘুরি করবে। জনমতের পালসটা তিনি যে ভাল বোঝেন, এ নিয়ে তেমন দ্বিমত নেই। এই ধমকে অনেক অপকর্ম আপাতত ঢাকা পড়ে যাবে।
কিন্তু একটা সহজ প্রশ্ন। মানুষ নার্সিংহোমে যায় কখন? যখন সরকারি পরিষেবার উপর তার ভরসা থাকে না। নার্সিংহোমে গেলে বেশি বিল লাগবে, কয়েকটা অবান্তর টেস্ট দেওয়া হবে, এই সহজ সত্যিটা তো সবাই জানেন। তবু সবাই সেখানেই ছুটছে কেন? কারণ, মানুষ জানে, সরকারি হাসপাতালে গেলে সেই পরিষেবা পাওয়া যাবে না। চূড়ান্ত দুর্ভোগ ও হয়রানি অপেক্ষা করছে। এখানে তবু বেশি টাকা নিয়ে টেস্ট করছে। সরকারি হাসপাতালে তো গিয়ে শুনতে হবে মেশিন খারাপ। নইলে হয়ত ডেট পাওয়া যাবে পনেরোদিন বা একমাস পর। ভিআইপি–র সুপারিশ ছাড়া ভর্তি হওয়াও যে কতটা কঠিন, যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা জানেন।
নার্সিংহোম কর্তাদের ধমক দেওয়ার আগে আত্মসমীক্ষা করুন কেন মানুষ নার্সিংহোমে ছুটে যাচ্ছেন? মুখে যতই সুপার স্পেশালিটির ঢাক পেটান, মানুষ সেখানে আস্থা রাখতে পারছে না। আপনার দপ্তরের উপর চূড়ান্ত অনাস্থা থেকেই মানুষ ছুটছেন নার্সিংহোমে। ধমকের লাইভ টেলিকাস্ট না দেখিয়ে একটু আয়নার সামনে দাঁড়ান।