এই বিশ্বকাপের বাজারেও, এই সারদা-ময় বাজারেও শিরোনামে উঠে আসছে চপ-তেলেভাজা। শিল্পের আঙ্গিনায় নাকি দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে উঠে আসছে বাঙালির চিরন্তন চপ আর তেলেভাজা। সেই আলোচনা পৌঁছে গেছে ভিনরাজ্যেও। এই নিয়ে গল্প লিখে ফেললেন প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার সব্যসাচী কুণ্ডু।
বিশ্বরূপ মণ্ডল কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকেন। গ্রামের বাড়ি বাঁকুড়ার কাছে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। অনেক দিন ধরে বড় সাহেবের কাছে ছুটির দরবার করতে করতে এইবার সেটা মঞ্জুর হয়েছে। তবে অল্প দিনের জন্য। হাতে সময় কম, তাই বাড়ি গিয়ে কী কী করবেন তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। অনেক কাজের মধ্যে একটা বিশেষ কাজ করতে হবে, সেটা হল গ্রামের মোড়ের মাথায় পঞ্চুদার স্পেশাল আলুর চপ খাওয়া। বাঁকুড়ার লোক তো, তাই তেলেভাজা জিনিসটা একটু বেশিই ভালোবাসেন। তাই সেদিন দুপুরে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যের মধ্যেই ছুটলেন মোড়ের মাথা থেকে চারটে আলুর চপ এনে মুড়ি দিয়ে বেশ আয়েস করে খাওয়ার লোভে । দিল্লিতেও তেলেভাজা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সেই গ্রামের স্বাদ কি আর পাওয়া যায়!
তা গ্রামের মোড়ে গিয়ে দেখেন পঞ্চুদার সেই টালির দোকানটা আর নেই। তার জাইগায় দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাসাদ প্রতিম অট্টালিকা ,যার নিচে কাঁচের দরজা জানালা লাগানো এক সুসজ্জিত রেস্তোরার মতো । উপরে একটা বেশ বড় সাইনবোর্ড লাগানো আর তাতে লেখা আছে- “ পি এস সি প্রাইভেট লিমিটেড , এখানে বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু তেলেভাজা সঠিক মূল্যে পাওয়া যায় , আমরা বিবাহ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরবরাহ করে থাকি , এখানে ক্রেডিট কার্ড ও গ্রহণ করা হয়’’
বিশ্বরূপ বাবু দু বার ঢোক গিলে লেখাটা পোড়ে ফেললেন। তারপর খানিক ইতস্তত করে কাঁচের দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। ঢুকতেই এক উর্দি পরা দারোয়ান এক লম্বা সেলাম মেরে বলল, আসুন স্যার, ভেতরে আসুন। ভেতরে ঢুকেই তো উনি হাঁ হয়ে গেলেন, এক বিশাল বড় সুসজ্জিত হলঘর, সারি সারি চেয়ার টেবিল পাতা আর সেখানে বসে অনেক লোক চপ তেলেভাজা খাচ্ছেন। উনি এদিক ওদিক তাকাছেন আর এই সময় একজন টাই সুট পরা ম্যানেজার গোছের ছোকরা এসে বললেন, “আসুন স্যার এদিকে আসুন। হ্যাঁ এখানে বসুন। আর বলুন কী খাবেন, এই নিন মেনু কার্ড, পছন্দ করে অর্ডার করুন।” বিশ্বরূপ বাবু গলাটাএকটুঝেড়ে বললেন , “ না না মেনু টেনু লাগবে না। আমার খালি চারটে আলুর চপ লাগবে মুড়ি দিয়ে খাব,হবে!”
“ আলবাত হবে স্যার আলুর চপ, মোচার চপ, কুমড়োর চপ আরও অনেক কিছুর চপ পাওয়া যায়। তাছাড়া পেঁয়াজি ও বেগুনিও পাবেন। আমরা হোম ডেলিভারি করে থাকি, তাছাড়া আমাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইনেও আপনি অর্ডার করতে পারেন। ফেসবুকেও আমাদের পেজ আছে লাইক করতে পারেন। কয়েকদিন পর ফ্লিপকার্টের সঙ্গে টাই আপ হবে। আপনি ফ্লিপকার্ট থেকেও অর্ডার করতে পারেন।’’
বিশ্বরূপ বাবু একটু আমতা আমতা করে ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলেন , “ আছা এখানে যে পঞ্চুদার চপের দোকানটা ছিল, সেটা কি উঠে গেছে?” ম্যানেজার বাবু একগাল হেসে বললেন, না না স্যার, এটা ওটাই , মানে আপনি বাইরের সাইনবোর্ডটা লক্ষ করেননি হয়ত।”
বিশ্বরূপ বললেন, “ওটা দেখলাম তো। ওখানে তো পি এস সি প্রাইভেট লিমিটেড লেখা আছে।” তখন ম্যানেজার বাবু বললেন , “ বুঝলেন না পি এস সি মানে পঞ্চুদার স্পেশাল চপ আর পঞ্চুদা মানে মিঃ পঞ্চানন মোদক হলেন এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর । ওই যে পাশের কাঁচের চেম্বারে বসে আছেন।” বিশ্বরূপবাবু উঁকি মেরে দেখলেন একজন সুট- টাই পরা ভদ্রলোক ল্যাপ টপে মগ্ন হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ দেখার পর চিনতে পারলেন , হ্যাঁ, পঞ্চুদাই তো। আগে লুঙ্গি আর গেঞ্জিতে দেখেছেন, তাই চিনতে আসুবিধা হচ্ছিল। এবার চেনা যাছে। এদিকে ম্যানেজার বাবু গড়গড় করে ওনাদের কোম্পানির ফিরিস্তি দিতে লাগলেন, আর বিশ্বরূপবাবুর মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। উনি ম্যানেজার বাবুকে বললেন , “ দেখুন আমার খালি চারটে আলুর চপ হলেই চলবে ।”
ম্যানেজারবাবু একটা ছোট্ট নোটবুকে নোট করে জিজ্ঞেস করলেন , “ তা স্যার খাবেন না পার্সেল করে দেব।” বিশ্বরূপবাবু বললেন, “ না না নিয়ে যাব পার্সেল করে দিন।” ম্যানেজারবাবু চলে গেলেন , কিছুক্ষণ পরে একজন উর্দি পরা ওয়েটার এসে পার্সেল আর বিলটা দিয়ে গেল। বিল খুলে দেখলেন একশো বারো টাকা পঞ্চাশ পয়সা। চারটে চপের দাম একশো বারো টাকা পঞ্চাশ পয়সা। এক একটা চপ পঁচিশ টাকা আর তার উপর ১২,৫% ভ্যাট। বিশ্বরূপবাবুর মাথা গরম হয়ে গেল। উনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “দু টাকার চপ পঁচিশ টাকা ? আমার সাথে ইয়ার্কি হচ্ছে ? শুনে তো সেখানের সব লোক খুব হাসাহাসি করতে লাগলো । চারিদিকে শুধু হা হা হি হি হাসির রোল আর কে যেন পাস থেকে ঠ্যালা দিছে।
হঠাৎ বিশ্বরূপ বাবুর ঘুম টা ভেঙ্গে গেল । চোখ খুলে দেখলেন উনি এখনও ট্রেনে আর ওনার পাশের বার্থের ভদ্রলোক ওনাকে ঠ্যালা দিয়ে বলতে লাগলেন “আরে মশাই উঠুন, ট্রেন বাঁকুড়া ঢুকছে যে,নামবেন না ? আর তখন থেকে চপ চপ কেন করছেন বলুন তো । সবাই শুনে হাসা হাসি করছে।”
বিশ্বরূপ বাবু খানিক লজ্জা পেলেন আর মনে মনে হাসতে হাসতে ভাবলেন কালকে ওই পেপারে পড়া খবরটা দেখছি মনের মধ্যে গেঁথে গেছে । আর বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন জয় বাংলার চপ শিল্পের জয়।