শরতের আকাশ বা সাদা কাশফুল নয়। এই পুজোর আবহেও ফেসবুক জুড়ে হঠাৎ তেরঙার ঢেউ। প্রোফাইল পিকচারে হঠাৎ দেশপ্রেমের ঢেউ। এত দেশপ্রেম আমদানি হল কোত্থেকে? আর কী কী বিপ্লব চলছে ফেসবুকজুড়ে? লিখলেন অয়ন দাস।।
সারাদিন পর রাতে ‘বই’-এর পাতা থেকে চোখ সরিয়ে ‘মুখবই’-এর পাতায় চোখ রাখতেই চক্ষু চড়কগাছ।দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার দেখতে পড়ি কি মরি করে দৌড়ালাম।না!মাস তো আগস্টও নয়, তারিখটাও ১৫ নয়। তাহলে হলটা কী?‘মুখবই’-এর ‘মলাটে’ থুড়ি ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে সবাই কেন তেরঙ্গায় রাঙিয়ে তুলেছে!তবে ভারত কি নতুন দিনে স্বাধীনতা দিবস পালন করছে!
ভুলটা ভাঙলো কিছুটা পরে, জনৈক এক ব্যক্তির মন্তব্য দেখে।বলা যায় ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের ‘ঝাড়ু’ আমার ভুলকে ‘ঝেঁটিয়ে’ বিদেয় করলো।বুঝলাম এই ‘দেশপ্রেম’-এর কারণ।
আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে নরেন্দ্র মোদীর ‘ডিজিটাল লাড্ডু’ খেয়ে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গ উৎফুল্ল হয়ে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র সমর্থনে ভারতের তেরঙ্গায় মোড়া নিজের একটি প্রোফাইল পিকচার আপলোড করেন। তা দেখে স্বয়ং মোদীও এরকম একটা ছবি ট্যুইট করেন। তারপরই শুরু দীর্ঘপ্রতীক্ষিত ‘সংগ্রাম’-‘বিপ্লব’-এর। ১২০ কোটির দেশে তা সুনামির মতো আছড়ে পড়ে। ভেঙে যায় সব শৃঙ্খল-বাঁধ। তেরঙ্গা মোড়া প্রোফাইল পিকচারে ছেয়ে যায় গোটা দেশ। সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত।
তবে ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে ওঠার এই ‘বিপ্লব’ মোটেই ফেলনা নয় বা লোক দেখানো একদিনের নয়। বছরে চার-পাঁচটা দিন তো হয়েই যায়। আগস্ট থেকেই শুরু হয় প্রতীক্ষার। ১৪ই আগস্ট ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটাকে স্পর্শ করলেই আসে ‘ছুটি’র থুড়ি ‘দেশপ্রেম’-এর জোয়ার ।সে এক ভয়ঙ্কর জোয়ার। পাড়ায় পাড়ায় বেজে ওঠে অ্যায় মেরি ওয়াতন কে লোগো। হড়পা বানও বলে ওঠে-“রাজামশাই তোমারে সেলাম’’।‘দেশপ্রেম’ পৌঁছে যায় এভারেস্টেরও গণ্ডি ছাড়িয়ে। কেউ ভারতের পতাকা,কেউ বা বিপ্লবীদের ছবি ‘মলাট’-এ লাগান। কোনো কোনো ‘দেশপ্রেমিক’-এর ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে বলার ধৃষ্টতাটুকু নেই আমাদের।তারা পতাকা হাতে বা পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে ‘সেলফি’ তুলে সেটা ‘মলাট’–এ আটকান। সে এক গায়ে কাঁটা দেওয়া মূহূর্ত-খাড়া হয়ে ওঠে রোম। নেহেরু আজ বেঁচে থাকলে এই ‘বিপ্লব’ দেখে নিশ্চয়ই আরো একবার বলতেন-“At the stroke of midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom”।স্বয়ং নেতাজী-গান্ধীজীও আপ্লুত হতেন, সাত-সমুদ্র পারে বিলেতেও আজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে-“ভাগ্যিস!সে সময়ে ভারতে এতো ‘বিপ্লবী’ ছিলো না”। এই ‘বিপ্লবী’দের চোখে জ্বলে ‘বিপ্লব’-এর আগুন আর সেই আগুনের শিখায় সকাল-সন্ধ্যার খেয়াল থাকে না।তাই সন্ধ্যা হয়ে গেলেও বাড়ির পুরোনো টিভির অ্যান্টেনাকে সম্বল করে মাথা উঁচু করে থাকে ভারতীয় পতাকা। হতে পারে তা নিয়মবিরুদ্ধ কিন্তু দেশপ্রেম ফেসবুকের দেওয়ালে আছড়ে পড়ছে তো,সামান্য একটা কাপড়ের টুকরোতে কি এসে যায়!
এই ‘বিপ্লবী’দের দেশপ্রেম যে কতটা গভীর তা জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে বা রাস্তায় তেরঙ্গা ফেলে রাখার মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়।জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে দাঁড়ালে তো তেরঙ্গার সমতুল্য হবার চেষ্টা করা হয়।তাই এই ‘বিপ্লবী’রা বসে থাকে, বাতের ব্যথার জন্য হাঁটু গেড়ে বসতে না পারলেও তারা বসেই সম্মান প্রদান করে।আর রাস্তায় তেরঙ্গা ফেলে রাখলে তো সবার মধ্যে ‘দেশপ্রেম’ ছড়িয়ে পড়বে। বছর খানেকের ‘দেশপ্রেম’-এর জোয়ার সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাবে। ফেসবুক ‘বিপ্লবী’রা অত্যন্ত কর্মঠও বটে। পাড়ার রকে, কলেজের ক্যান্টিনে গর্জে ওঠে তারা-‘এ দেশের কিচ্ছু হবে না’।এভাবেই তারা দেশের সকল মানুষকে সচেতন করে তারপরই ‘কিছু করবে’।
এই ‘বিপ্লবী’দের কেবলমাত্র দেশপ্রেমিক বলে ‘ছোটো’ করলে আমার ‘পাপ’।‘ফাদার্স ডে’-‘মাদার্স ডে’ তেও তারা মা-বাবার প্রতি ‘ভালোবাসা’র ঝাঁপি ফেসবুকের দেওয়ালে উন্মুক্ত করে দেয়। কোনও কোনঅও ‘সাম্রাজ্যবাদী’ লোক বলে ফেসবুকে ‘ফাদার্স-মাদার্স ডে’ করে সেদিনই ঘরে চূড়ান্ত বাজে ব্যবহার করে।কিন্তু তাতে কি!ক্ষুদিরাম বসু যে বোমা মেরেছিলেন সেটা সবাই মনে রেখেছে, ঘরে কীভাবে আগেরদিন ছিল সেটা কেউ মনে রেখেছে নাকি! এসব ছেঁদো যুক্তি ‘বিপ্লবী’দের এই ‘বিপ্লব’কে কক্ষনও আটকাতে পারবে না।‘বিশ্ব নারী দিবস’ বা ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ নিয়ে এই বৈপ্লবিক সংগ্রাম সেভাবে শুরু না হলেও অদূর ভবিষ্যতে বিপ্লবের ‘লেলিহান’ শিখা ওই দিনগুলিতেও ছড়িয়ে পড়বে সে ব্যাপারে ‘তারা’ আশ্বাস প্রদান করেছে।
এই ‘বিপ্লবী’রা সমাজেরও যে কোনো ঘটনায় ফেসবুকে ‘মলাট’ পাল্টে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। যাদবপুরে ছাত্রী-নিগ্রহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ‘হোক কলরব’ আন্দোলন শুরু হয় তাকে সমর্থন জানাতে তারা তাদের ‘মলাট’-‘দেওয়াল’ ভরিয়ে তুলেছিল।শুধু তাই নয়, মিছিলে হাঁটার, আইসক্রিম খাবার ছবি আপলোড করে ‘ফিলিং বিপ্লবী’ ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা আন্দোলনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে টিভি,কাগজে শুধু তাদের ছবি বেরোতে থাকে।তবে কেউ কেউ অনুযোগ করে যে ছবিতে ‘পোজ’ গুলো ঠিক হয়নি।দু-একজন নিগৃহীতা ছাত্রীর সুবিচার না পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।আরে!ইতিহাসের সব বিপ্লব সফল হয়েছে নাকি!কিছু তো সফল তো হয়েইছে-‘হোক মলাট ভরানো’।
কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মারা গেলেও ‘বিপ্লবী’দের তৎপরতা মন ছুঁয়ে যায়, তারা সেই বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ছবি তাদের ফেসবুকের মলাটে-দেওয়ালে দিয়ে প্রার্থনা করে একদিন তো নিশ্চয়ই ‘ছুটি’ পাওয়া যাবে।সে ‘ছুটি’ কিন্তু ‘শোক’প্রকাশের ছুটি।
এই একটা মুহূর্তই জীবন আমার পাল্টে দিলো,‘দেশপ্রেমিক’ করে তুললো আমাকেও।যাই, আমার ফেসবুকের ‘মলাট’-এর জন্য তেরঙ্গা অ্যাপের দারস্থ হই। তবেই তো বলতে পারবো-‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। না হলে আমাকেও ‘অ্যানালগ ইন্ডিয়া’য় দিন কাটাতে হবে।