কেন্দ্রে মাইনে বাড়ছে। শিক্ষক ও সরকারি কর্মীদের দুঃখের শেষ নেই। তাঁরা শুধু হিসেব কষছেন। সরকারকে গাল পাড়ছেন, কিন্তু মহৎ আদর্শের কথাটা বুঝতেই পারছেন না। ডি এ নেই তো কী হয়েছে? উপার্যনের নানা রাস্তা বাতলে দিলেন রবি কর।
আবার শুরু হল রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ নিয়ে কাঁদুনি। শুধু ডিএ নয়, এবার আবার যোগ হয়েছে পে কমিশন। ‘কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারিদের মাইনে বাড়বে, আমাদের কেন বাড়বে না? আমাদেরও মাইনে বাড়াতে হবে । অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ।’
সত্যি বলছি, এরকম হিংসুটে জাত আমি দুটো দেখিনি। ‘কেন্দ্রের মাইনে বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। তখন আমাদের তো ভিখারির দশা হবে।’ – অফিসে অফিসে খালি এই আলোচনা। ওরে মাকালের দল, ঈর্ষা না করে মাথা খাটিয়ে দেখ, কত বড় একটা আদর্শকে সামনে রেখে দিদিমণি তোদের মাইনে কমিয়ে রেখেছেন। জীবনে ডিএ বা মাইনে বা পে কমিশন সব নয়। আদর্শটাই হল আসল।
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কেবল নিজে সাহিত্যিক নন, অতীতের দিকপাল সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধা। আমাদের অনুমান, তিনি বিদ্রোহী কবি নজরুলের সেই কবিতাটি পড়েছেন, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান।’ মুখ্যমন্ত্রী নিজে মহান, তিনি চান তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরাও মহান হোন। নজরুল পড়ে তিনি বুঝেছেন, দরিদ্র করে না রাখলে এই হাড়বজ্জাতগুলো মহান হবে না। সুতরাং —।
তাছাড়া ধরুন, ৩৪ বছর ধরে কোঅর্ডিনেশন, সিটু, এবিটিএ করে করে রাজ্য সরকারি কর্মীদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ, স্বদেশপ্রেম একেবারেই কমে গেছে। এই সমস্যার প্রতিকারে উদ্যোগী হয়েছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। ওই যে, স্বদেশি যুগের গান আছে- মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই। দিদি জানেন, মাইন বাড়ালেই সরকারি কর্মচারিরা মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় ছেড়ে শাশুড়ির দেওয়া মিহি কাপড় পরবে। আর জাতীয়তাবোধের দফারফা হবে। তাই দিদিমণি ডিএ, পে কমিশন, সবকিছু শিকেয় তুলে রেখেছেন। যাতে কর্মীরা মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, দিদির দেওয়া হাওয়াই চটি মাথায় তুলে রাখে। বিনোদন বলতে শুধু তেলেভাজা খাওয়া। অর্থাৎ, তেলেভাজা শিল্পের উন্নতি।
মোদ্দা কথা, দিদি জানেন, বাচ্চা ছেলেদের হাতে বেশি টাকা দিলে তারা যেমন বখে যায়, সরকারি কর্মীরাও তাই। বেশি টাকা পেলেই তারা মা মাটি মানুষের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে। হাওয়াই চটি ছেড়ে গামবুট পরবে, টালির বাড়ি ছেড়ে আলিমুদ্দিনের ঝাঁ চকচকে বাড়ি পুজো করবে। খেতে পেলেই তারা শুতে চাইবে। বলবে আরও দে, আরও দে। তার থেকে টাকা না দিয়ে ভিখারির দশা করে দেওয়া ভাল। তখন চার আনা, আট আনা দিলেই জিভ দিয়ে জল গড়াবে।
তাছাড়া এই সরকারি কর্মীরা হল বেইমানের জাত। বিহারে নীতীশ কুমার একশো পারসেন্ট ডিএ দেয়। কিন্তু যতক্ষণ পোস্টাল ব্যালট গোনা হচ্ছিল, ততক্ষণ বিজেপি জিতছিল। অর্থাৎ, একশো পারসেন্ট ডিএ পেয়েও ব্যাটারা সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। এই যাদের চরিত্র, তাদের পিছনে দিদিমণি টাকা খরচ করবেন কেন? তার থেকে ক্লাবগুলোকে টাকা দিলে ভোটের সময় তারা জান লড়িয়ে দেবে।
তবে হ্যাঁ, দিদি তো রবীন্দ্র অনুরাগিনী। তিনি পুজোর সাজ কবিতাটি পড়ছেন। ‘আশ্বিনের মাঝামাঝি, উঠিল বাজনা বাজি, পুজোর সময় এল কাছে।’ দিদিমণিও আশ্বিনের মাঝামাঝি পে কমিশনের বাজনা বাজিয়েছিলেন। কবিতায় মধু-বিধু দুই ভাই যেমন নতুন জামা পাবার লোভে আনন্দে দু হাত তুলে নেচেছিল, সরকারি কর্মীরাও পে কমিশনের লোভে আনন্দে দু হাত তুলে নেচেছিল। কিন্তু দিদিমণির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কত মিল। মধু-বিধুও পুজোর জামা পায়নি, কর্মীরাও পে কমিশন পায়নি। এরপর যার ক্ষমতা আছে, সে মধুর মতো ভিক্ষে করে শাটিংয়ের জামা পর গে যা। পে কমিশন নেই, ডিএ নেই, কিন্তু বিদেশ ভ্রমণের সার্কুলার বেরিয়ে গেছে। বিদেশে গিয়ে কোথায় থাকবি, কী খাবি, তা নিজেরাই ঠিক কর। কিন্তু বামপন্থীরা দিদিমণির প্রতিভা কিছুতেই স্বীকার করে না। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত এত কিছু দেখেও তারা বলছে, দিদিমণি কর্মীদের হকের টাকা মেরে নয়ছয় করছেন। বামপন্থী বন্ধুদের বলি, খুব তো সর্বহরারা দুনিয়া জয়ের কথা বলিস, দিদিমণি তো সেই আদর্শেই বিশ্বাস করেন। তিনি ধাপে ধাপে সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষকদের সর্বহারা বানিয়ে দেবেন। তখন দুনিয়া জয়ের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমার তো মনে হয়, দিদিমণি আদর্শ বামপন্থীর মতোই কাজ করছেন।
আর সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষকদের বলি, আপনারা দয়া করে কুচুটেপনা আর হিংসা একটু বন্ধ করুন। রাজ্য সরকারের সামনে নীল সাদা রঙ করা, ত্রিফলা বাতি বসানো, মোমের মিউজিয়াম বানানো, দুর্গা প্রতিমা সংরক্ষণ করা, সেরা কার্তিক পুজোর পুরস্কার দেওয়া, বঙ্গভূষণ দেওয়া, টিভি সিরিয়ালগুলোকে পুরস্কার দেওয়া, শাহরুখ খানকে মাছভাজা খাওয়ানো, রাজ্যজুড়ে নিমগাছ রোপন, খাদ্য উৎসবে কোয়েলের মাংস খাওয়ানো, মুরগির ছানা বিতরণ, ইমামদের ভাতা দেওয়া- প্রভৃতি অনেক অনেক জনহিতকর কাজ আছে। আপনারা আধপেটা খেয়ে থাকলে কারও কিছু যায় আসে না। মা মাটি মানুষের কল্যাণে এটুকু ত্যাগস্বীকার আপনাদের অবশ্যই করা উচিত।
মনে রাখবেন, বাসের পেছনে লেখা থাকে, হিংসা কোরো না, চেষ্টা করো, তোমারও হবে। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের হিংসে না করে আপনারাও চেষ্টা করুন। ইট, বালির সিন্ডিকেট খুলুন, চিটফান্ডের ব্যবসা করুন, কোনও একটা ক্লাবের মেম্বার হয়ে বাম, বিজেপি, কং নেতাদের মাথায় চাঁটি মারুন। তারপর দু লক্ষ টাকা অনুদানের আবেদন করুন। মদন মিত্র জিন্দাবাদ বলে পোস্টার লাগান। দেখবেন, ডিএ না পাওয়ার দুঃখ আপনি ভুলে যাবেন। মানে, ডিএ-র ক্ষতি মেরামত করার পথ আপনি খুঁজে পাবেন। বসে বসে বেঙ্গল টাইমস না পড়ে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হোন। হিংসা কোরো না, তোমারও হবে।