স্বরূপ গোস্বামী
রাজ্য রাজনীতিতে দারুণ মজার একটি গল্প আছে। একবার সুব্রত মুখার্জির কিছু টাকা দরকার। ফোন করলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে। প্রিয়দা, কাল কিছু টাকা দরকার।
মুশকিল আসান প্রিয়বাবু বললেন, ঠিক আছে, কাল বিকেলে এয়ারপোর্টে চলে আসিস। আমি দিল্লি যাব। যাওয়ার পথে এয়ারপোর্টে দিয়ে দেব।
পরেরদিন বিকেল। এয়ারপোর্ট নয়, সোজা হাওড়া স্টেশনে হাজির সুব্রত। রাজধানী এক্লপ্রেসে ঠিক খুঁজে নিলেন প্রিয়রঞ্জনকে। তাঁকে দেখে যেন ভূত দেখছেন প্রিয়রঞ্জন।
সুব্রত বলে উঠলেন, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তুমি যখন বলেছ, প্লেনে যাবে, তখনই বুঝেছি তুমি ঠিক ট্রেনে যাবে। তোমাকে আর কেউ না চিনুক, আমি তো চিনি। যেটা দেবে বলেছিলে, দাও দেখি।
গল্পটা মিথ্যে নয়। সাতের দশকে এমনটাই ঘটেছিল। তবে লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে হয়ত একটু অতিরঞ্জন থাকতে পারে। এমন কত কাহিনি রয়ে গেছে প্রিয়রঞ্জনকে ঘিরে। যাঁরা কাছের মানুষ, তাঁদের স্টকে এমন কত গল্প যে মজুত রয়েছে। সত্যি না মিথ্যে এই মানদন্ডে নাই বা দেখলেন। সহজ কথা, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি রাজ্য রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্র।
কখনও তিনি রাজ্য উত্তাল করে দেওয়া ছাত্রনেতা, কখনও সারা ভারত যুব কংগ্রেস সভাপতি। কখনও তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। কখনও তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ একজন, কখনও তিনি প্রদেশ সভাপতি, কখনও লোকসভায় বিরোধীদের চিফ হুইফ, কখনও হেরে যাওয়া-পদহীন এক বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসী, কখনও ভারতীয় ফুটবলের দন্ডমুন্ডের কর্তা, কখনও কবি ও সম্পাদক, কখনও যে কোনও বিতর্কসভা একাই মাতিয়ে দেওয়ার মতো তুখোড় বাগ্মী।
একসঙ্গে এতরকমের পরিচয়! আর কোনও বাঙালিকে এইসব ভূমিকায় দেখা গেছে কিনা সন্দেহ। দিল্লির রাজনীতিতে যদি পাঁচজন বাঙালিও নিজের প্রভাব তৈরি করে থাকেন, তবে সেই তালিকায় প্রিয়রঞ্জনের নামটা থাকবেই। সেই মানুষটা কেমন আছেন, আজ আর কেউ খোঁজও রাখে না। বেঁচে আছেন, কিন্তু বেঁচে না থাকার মতোই। আগে তবু জানা যেত, হাসপাতালে আছেন। বহুদিন তাঁকে নিয়ে কোনও খবর বা প্রতিবেদন দেখিনি। আজ তাঁর জন্মদিন। যদি তিনি লোকসভায় থাকতেন! নিশ্চিত থাকুন, নরেন্দ্র মোদি যে লোকটিকে নিয়ে সবথেকে বেশি চিন্তায় থাকতেন, তাঁর নাম প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি।
বাংলার যে কোনও জেলায় যান। প্রিয়পন্থী কয়েকজন নেতাকে ঠিক পেয়ে যাবেন। তাঁদের অনেকে হয়ত এখন তৃণমূলে। কিন্তু তাঁর হাত ধরেই উঠে আসা লোকের তালিকা করতে গেলে, সে তালিকা খুব দীর্ঘ হয়ে যাবে। তাঁরাও কি খোঁজ রাখেন প্রিয়রঞ্জনের ? কজন দেখতে গিয়েছিলেন ? দীপা দাশমুন্সিকে অন্তত এই একটা কারণের জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হবে। জানেন, আর কোনওদিনই তাঁর স্বামী সেরে উঠবেন না। তবু প্রাণপনে লড়ে যাচ্ছেন। যতটুকু করা সম্ভব, করছেন।
আজকের মমতার উত্থানের পেছনেও প্রিয়র ভূমিকা কম ছিল না। দিল্লির বুকে মমতার লড়াইয়ে দিনের পর দিন পাশে থেকেছেন। বয়সে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও সেই নয়ের দশকেই মমতার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। সে দিনগুলো মুখ্যমন্ত্রীর মনে আছে কিনা কে জানে! শেষ কয়েকটা বছরে প্রিয়র সবথেকে বড় স্বপ্ন ছিল রায়গঞ্জে এইমস তৈরি করা। এইমস হলে যদি দীপার গুরুত্ব বেড়ে যায়! তাই, রাজ্যের সহযোগিতা তো পানইনি। উল্টে সেটা আটকাতে যা যা করা দরকার, সব করা হয়েছে।
আজ প্রিয়রঞ্জন এসব ভাবার জায়গায় নেই। হয়ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। চেনা মানুষকেও আর চিনতে পারেন না। আজ তাঁর ৭১ তম জন্মদিন। যাঁদের হাত ধরে তুলে এনেছেন, তাঁদের কেউ কি ফুল নিয়ে গিয়েছিলেন? জানা নেই। যখন তিনি ক্ষমতার শীর্ষে, কত অনুগামীই হয়ত বলেছিলেন, চিরদিন পাশে থাকব। একমাত্র দীপা ছাড়া কেউই সেভাবে পাশে নেই। প্রিয় হয়ত মুচকি হাসছেন। আর সুনীল গাঙ্গুলির কবিতা আউড়ে বলে যাচ্ছেন, কেউ কথা রাখেনি।