স্বরূপ গোস্বামী
দুটো আস্ত দিন পেরিয়ে গেল। পেরিয়ে গেল তিনটে আস্ত রাত। এখনও তোমার দেখা নেই। তুমি কোথায় আছো, কী অবস্থায় আছো, কিছুই নিশ্চিত করে জানি না। তবে স্নেহের স্বভাব নাকি অকারণ অনিষ্টের আশঙ্কা করা। হ্যাঁ, বয়সে তুমি কিছুটা ছোট। দীর্ঘ সময় একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। তাই, স্নেহ থাকাটাই স্বাভাবিক। সেই স্নেহ থেকে মনে উল্টো পাল্টা চিন্তা আসছে না, এমনও নয়। তবে, এখন মনে হচ্ছে, তোমাকে শুধু স্নেহ করি না। তোমার লড়াকু সত্ত্বাকে কোথাও একটা কুর্নিশও করি। কেন জানি না, বারবার মনে হচ্ছে, সব অপচেষ্টাকে হারিয়ে তুমি আবার ফিরে আসবে।
তুমি ফিরে এলে কী কী হতে পারে ? তোমার শহরে সৌরভ চক্রবর্তী বলে এক নেতা আছেন। তিনি হয়ত বিজয় মিছিল বের করবেন। শিলিগুড়িতে গৌতম দেব বলে এক মন্ত্রী আছেন। তিনি শিলিগুড়ির বুকে ঘটা করে একটা প্রেস কনফারেন্স করবেন। নিজের সাফল্যের ঢাক পেটাবেন। তোমার খোঁজে মুখ্যমন্ত্রী কতবার ফোন করেছেন, তার ফিরিস্তি দেবেন। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণাতেই তোমাকে খোঁজা সম্ভব হয়েছে, এরকম বিবৃতিও দিতে পারেন। নবান্নে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী কী কী বিবৃতি দিতে পারেন, তাও অনুমান করাই যায়। তখন তোমার অপহরণ হওয়ার ঘটনাটা চাপা পড়ে যাবে। কারা এর পেছনে আসল নায়ক, তাও আড়ালেই থেকে যাবে। শুধু তোমাকে উদ্ধারের ব্রেকিং নিউজ দেখা যাবে বাংলা চ্যানেলে।
গতকালও আলিপুরদুয়ারে তোমাকে খুঁজে আনার দাবিতে সর্বাত্মক বনধ হয়েছে। বিভিন্ন কাগজের উত্তরবঙ্গ এডিশনে সেসব কভারেজ আছে। কিন্তু কলকাতা এডিশনে! না, চয়ন, প্রথম পাতায় তোমার জায়গা হয়নি। যে কাগজে তুমি সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেছিলে, সেই কাগজের কলকাতা এডিশনেও তোমার অপহরণের খবর ছাপা হয়নি। হ্যাঁ, আমি নিজেও এক দশক সেই কাগজে ছিলাম। এখনও সবার আগে সেই কাগজটাই পড়ি। কিন্তু গতকাল তোমাকে নিয়ে একলাইনও নেই দেখে সত্যিই খুব লজ্জা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ তোমার অপহরণের কথা না ছেপে কাকে খুশি করতে চাইছেন, কে জানে! বাকি যে দু একটা কাগজে আছে, নিতান্তই দায়সারা।
সাংবাদিক আক্রান্ত, এই রাজ্যে এটা আর নতুন খবর নয়। বাম জমানাতেও সাংবাদিকরা দারুণ স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেছেন, এমন দাবি করব না। বিশেষত জেলা স্তরে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা আছে। তবু কোথাও একটা রাখঢাক ছিল। এখন সবকিছুই যেন বেআব্রু। বাঁকুড়ায় ভোজালি দিয়ে কোপানো হল স্বপন নিয়োগীকে। মুহূর্তের উত্তেজনায় নয়, একেবারে ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পনা করে খুনের চেষ্টা। যদি নিছক কিছু দুর্বৃত্ত এই কাজটা করত, তাহলে এতখানি আশঙ্কার কিছু ছিল না। খারাপ লাগে, যখন দেখি শাসকদল এই জাতীয় নিন্দনীয় ঘটনার পরেও উদাসীন। নিন্দাপ্রকাশ করতেও ভয়, যদি দলীয় পদ চলে যায়!
তোমার উপর হামলাও ব্যতিক্রমী কিছু নয়। প্রথমে তোমার বীরপাড়ার বাড়িতে আক্রমণ হল। তোমাকে না পেয়ে, তোমার বৃদ্ধ বাবাকে মারধর করা হল। তোমার বাড়ি ভাঙচুর করা হল। কারা হামলা চালালো, সবাই জানে। তবু বীরদর্পে ঘুরে বেড়িয়েছে দুর্বৃত্তরা। বুক ফুলিয়ে টিভিতে বাইটও দিয়েছে। রবিবার পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। কার ভয়ে পুলিশ তাঁদের ছুঁতে পারেনি, তাও কারও অজানা নয়। হামলায় মূল অভিযুক্ত যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি। তা সত্ত্বেও শাসক দল কীভাবে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে ! কোনও যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মিডিয়ার দৌলতে কেউ কেউ নেতা হয়ে যান। তেমনই একজন তোমার শহরের সৌরভ চক্রবর্তী। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘বিষয়টি দুঃখজনক। পুলিশকে বলেছি, তদন্ত করতে।’ তুমি শহরে থাকলে হয়ত পাল্টা প্রশ্ন করতে, ‘পুলিশকে বলার আপনি কে?’ মানছি, সৌরভ জেলা সভাপতি। সবাই জানে, তাঁর কথাতেই জেলার প্রশাসন চলে। তবু ‘পুলিশকে বলেছি’ এই কথাগুলো যে প্রকাশ্যে বলতে নেই, সেটা ওই অর্বাচীনদের কে বোঝাবে ?
চয়ন, তুমি বা তোমার মতো কিছু লড়াকু সাংবাদিককে ওরা বড্ড ভয় পায়। তোমরা প্রশ্ন তুলেছ, কলেজে গুন্ডামি হলে, তোলাবাজি হলে, সেই কথা লিখেছো। হুমকি তো আগেও এসেছে। দমে যাওনি। মাথা উঁচু রেখে সাংবাদিকতা করেছো। তাই ওরা বাড়িতে গুন্ডা পাঠাল। ভাবল, তোমাকে ভয় দেখাবে। কিন্তু ভয় না পেয়ে পরের দিন তুমি এফ আই আর করলে। একেবারে জেলা তৃণমূল যুব সভাপতির নামে। সেই সমর ভট্টাচার্য কার ডান হাত, তুমি জানতে না ? সৌরভ চক্রবর্তী কেন তাকে আগলে রাখে, তুমি জানতে না ? তাকে চটালে কোন উদীয়মান নেতার কোন গোপন কাহিনী বেরিয়ে পড়বে, তুমি জানতে না! সাতদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কেউ গ্রেপ্তার হল না। ওরা ভেবেছিল, সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যাবে। অন্য অনেকেই ভয়ে গুটিয়ে যেত। এরপরেও তুমি পিছিয় আসোনি। ঠিক করলে, সোমবার থেকে অনশনে বসবে। তার আগে, রবিবার রাতেই তোমাকে ‘ভ্যানিস’ করার চেষ্টা।
চয়ন, তোমার হাতে ছুরি বা বন্দুক ছিল না। গলায় ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত আর ভাওয়াইয়া। হাতে ছিল একটা ক্যামেরা, যা দিয়ে তুমি জঙ্গলের গভীরে গিয়ে নানা প্রজাতির পাখির ছবি তুলতে। তবু তোমার চোখের দিকে তাকাতে ওরা ভয় পেত। তাই রাতের অন্ধকারকে বেছে নিয়েছিল। কখন তুমি গভীর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ফিরছো, ওরা ওত পেতে ছিল।
পাহাড় আর জঙ্গলঘেরা তোমার ওই শহর আমারও বড় প্রিয়। একটু দূর গেলেই ভুটান সীমান্ত। পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াই কতবার সেই বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছি। আরেকদিকে, কিছুটা গেলে আসাম বর্ডার। অনায়াসে চলে যাওয়া যায় ভিনরাজ্যে। আরেকদিকে বাংলাদেশ। সেখানে যাওয়া একটু কঠিন, তবে যোগাযোগ থাকলে, অসম্ভব নয়। কিডন্যাপিংয়ের জন্য এমন আদর্শ জায়গা আর কটা আছে ? আমাদের আশঙ্কা, একেবারে পেশাদার কিডন্যাপারদের দিয়েই তোমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আমাদের আশঙ্কা, এই রাজ্যে তোমাকে রাখাও হয়নি।
তোমার দুটো ফোনই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমাদের সাইবার সেল এত বিখ্যাত। তারা টাওয়াল লোকেশন দেখে কাশ্মীর থেকে সুদীপ্ত সেনকে ধরে আনতে পারে, মুম্বই থেকে লক্ষ্ণণ শেঠকে ধরে আনতে পারে। তারা তোমার হদিশ পাচ্ছে না ? মুখ্যমন্ত্রী নাকি খুব উদ্বিগ্ন। তিনি নাকি বারবার খোঁজ নিচ্ছেন। তাঁর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু এই অপহরণের নেপথ্যে কারা, তা খুঁজে বের করা কি খুব কঠিন ? অপরাধ বিজ্ঞানের কতগুলো সহজ পাঠ আছে। এগুলো জানতে ফেলু মিত্তির বা ব্যোমকেশ বক্সী হতে হয় না। যিনি বাড়ি ভাঙচুরে মূল অভিযুক্ত, তাঁকে একবার জেরা করা যেত না ? অবাক লাগে, যখন দেখি তোমাকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে সৌরভ চক্রবর্তী মিছিল করছেন। যখন তোমার বাড়ি ভাঙচুর হল, তখন তিনি কী করছিলেন ? উল্টে, যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের আড়াল করে গেছেন। তোমার অপহরণের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না, এটা বিশ্বাস করতে হবে ? মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর কাছে আপনি বারবার ফোন করে খবর নিচ্ছেন, সবার আগে তাঁকে জেরা করার ব্যবস্থা করুন। পুলিশকে নির্দেশ দিন, যাঁদের বিরুদ্ধে চনয় এফ আই আর করেছিলেন, আগে তাদের ধরা হোক। তাদের আড়ালে কারা, তাদের চিহ্নিত করা হোক।
চয়ন, তুমি ফিরে এলে অনেকের অনেক বিপদ। তাই তোমাকে কি ফেরানো হবে ? জানি না, খুব ভয় করছে চয়ন। তুমি বুঝিয়ে দিয়ে গেলে, আমরা কতটা মেরুদন্ডহীন। বাংলার বুকে এক সাহসী ও লড়াকু সাংবাদিককে অপহরণ। তবু আমরা কত উদাসীন। তোমাকে নিয়ে ‘ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমন’ বা এই জাতীয় কোনও অনুষ্ঠান হয় না। তার বদলে ‘পর্নসাইট না থাকলে মৌলিক অধিকার হরণ’ এই সব নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়। কতকাল আগে সুনীল গাঙ্গুলি লিখেছিলেন, চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়। চয়ন, তোমার উধাও হয়ে যাওয়া আমাদের বড় লজ্জিত করে দেয়।
তবু বলছি চয়ন, ফিরে এসো। আমরা নাচানাচি করব। চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখাব। নেতা, মন্ত্রীরা প্রেস কনফারেন্স করবেন। এই ভন্ডামি দেখতে তোমার ভাল লাগবে না, জানি। তবু বলছি, ফিরে এসো।