ময়ূখ নস্কর
জীবনে কখনও কোনও দেবতার মন্দিরে বা কোনও পীরের দরগায়, কোনও কিছুর জন্য প্রার্থনা জানাইনি। কিন্তু বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমাটি দেখার পরে মনে হল, একবার দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় সুতো বাঁধব। সেখানে প্রার্থনা করলে নাকি মূক কথা বলে। মনে হল, একবার পাকিস্তানের হজরত আমিন শাহের দরগায় চাদর চড়াব। সেখানে প্রার্থনা করলে নাকি হারানো স্বজন ফিরে আসে।
বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমাটির গল্প এতদিনে সবার জানা হয়ে গেছে। যারা জানেন না তাঁরাও অবিলম্বেই জেনে যাবেন। তাই গল্পটা বলে আর পণ্ডশ্রম করছি না। বরং ভাবার চেষ্টা করছি, সিনেমাটা হিট করল কোন মন্ত্র বলে? শুধু সলমনের সিনেমা বলে? কিন্তু যে যে কারণে বছরের পর বছর ধরে সলমনের নিজস্ব ভক্তকুল গড়ে উঠেছে তার কিছুই তো এই সিনেমায় নেই! মিনিট দুয়েকের একটা ছোটো দৃশ্য ছাড়া কোনও অ্যাকশন নেই। শার্ট খোলার দৃশ্য নেই। ঢলঢলে প্রেম নেই। মাত্র দুটি নাচ, তাতেও হিট হবার মশলা নেই। এমনকি এই সিনেমায় সলমনের বুদ্ধি একটি ৬ বছরের বাচ্চার থেকেও কম। তাহলে?
তাহলে কি ওই পাকিস্তানি মেয়েটির জন্যই সিনেমাটি হিট করল? যে নিজে বোবা হলেও ডাগর চোখের ভাষায় হিন্দুস্তানের তামাম দর্শককে বাৎসল্য রসে আকুল করে দিল। ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তান, ভারতকে হারাচ্ছে। মেয়েটি আনন্দে পাকিস্তানের পতাকায় চুমু খাচ্ছে। তবু কী আশ্চর্য আমাদের গায়ে এতটুকুও জ্বালা ধরল না। বরং মনে হল, এমন মেয়েকে হারিয়ে ওর মা-বাপ কেমন করে আছে। দর্শকদের মনের এই অপূর্ব মায়াই কি বজরঙ্গি ভাইজানের সাফল্যের কারণ?
না কি সিনেমা হিট হল, সলমন অভিনিত পবন চতুর্বেদী চরিত্রটির জন্য? যে নিজে আর এস এস নেতার ছেলে হয়েও মুসলমান মুন্নির জন্য দরগায় মানত করে? সব বিপদকে অগ্রাহ্য করে বিনা পাসপোর্টে পাড়ি দেয় পাকিস্তানে? আর তার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ি দেয় আমাদের মন।
কিন্তু কেন? শত্রু দেশের মেয়ে দেশে ফিরতে পারল কিনা তার জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে কেন? তবে কি আমরা বুঝতে শিখেছি, যে শত্রুর চোখের জল ঝরায়, তার থেকে অনেক বড় বীর সে, যে শত্রুর চোখের জল ভাগ করে নেয়? তবে কি আমাদের মনের মধ্যে আজও লাহোর-করাচির জন্য বিয়োগ ব্যথা লুকিয়ে আছে? যে মনের তৃষ্ণা শুধু গঙ্গার জলে মেটে না, রাভির পানির প্রয়োজন হয়।
হজরত আমিন শাহের দরগায় মানত করলে নাকি হারানো স্বজন ফিরে আসে। আমাদের দুঃখী মন কি আজও সেই দরগায় মাথা খুঁড়ে বলে, ৬৮ বছর আগে যেসব স্বজন আমার পর হয়ে গেছে, তারা আবার আমার বুকে ফিরে আসুক? নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় মানত করলে নাকি বোবা কথা বলে। আমাদের মন কি আজও কান খাড়া করে থাকে, কাঁটাতারের ওপার থেকে ভাই ডাক শুনবে বলে?
সিনেমার শেষ দৃশ্যে তো তাই হল। বোবা মেয়েটি প্রাণান্তকর চেষ্টায় চিৎকার করে উঠল। তাই শুনে হল ভর্তি যে করতালি, তা কি শুধুই সল্লু ভাইয়ের জন্য?
হিন্দি সিনেমার রীতি মেনে বজরঙ্গি ভাইজানে কিছু অসম্ভব ঘটনা রাখতেই হয়েছে। যেমন সব জেনেও পাকিস্তানি রেঞ্জার্সের এক অফিসার সলমনকে অনুমতি দেন, সেদেশে ঢোকার। আবার সলমনকে ভারতে ফেরত পাঠানোর জন্য সেদেশের মানুষ সীমান্তের বেড়া ভেঙে দেয়। নীরবে দূরে সরে যায় পাক সেনা। এসব হয় না, হতে পারে না।
কিন্তু এই অবাস্তবতার মধ্যেও কী সুখ! মনে হয় এই সুখানুভূতির জন্য সব লজিক শিকেয় তোলা থাক। জনগণ বেড়া ভাঙুক, ভাঙুক, ভাঙুক। চিৎকার করে বলুক “ভাইজান।”
“রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা, এমন কেন সত্যি হয় না আহা।”
হে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, হে আমিন শাহ, হে বজরংবলী, আপনারা সবাই মিলে পারেন না এমন অসম্ভবকে সম্ভব করতে? পারেন না হিন্দু-মুসলমান, মুন্নি-সাহিদা, ভারত-পাকিস্তান সব এক করে দিতে? যদি পারেন, আমি নাস্তিক হয়েও আপনাদের দরগার ধুলোয়, মন্দিরের চাতালে গড়াগড়ি দেব।