সরল বিশ্বাস
ভারতী ঘোষকে বঙ্গভূষণ বা বঙ্গবিভূষণ দেওয়াই যায়। এমনকি পদ্মশ্রীর জন্যও তাঁর নাম সুপারিশ করা যায়।
না, শিলিগুড়ির বর্ষীয়াণ টেবিল টেনিস কোচ ভারতী ঘোষ নন। এই প্রজন্মের অনেকে তাঁকে চেনেনও না।
এই ভারতী ঘোষ ‘স্বনামধন্য’। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার। পুলিশ সুপার সব জেলাতেই আছেন। কিন্তু এমন ‘প্রতিভা’ সম্ভবত আর কারও নেই। রাজ্যব্যাপী এমন পরিচিতিও আর কারও নেই।
আই এ এস, আই পি এস—এসব শুনলে আগে অনেকটাই শ্রদ্ধাভক্তি হত। এখনও হয়ত কিছুটা হয়। কিন্তু এই রকম আই এ এস, আই পি এসদের নমুনা দেখার পর আর হয় না। মনে হয়, আই পি এস হওয়ার তো দূরের কথা, একজন কনস্টেবল হওয়ার মতো যোগ্যতাও বোধ হয় তাঁদের নেই।
সবংয়ের সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ে যে ছাত্ররা লাঠি নিয়ে হামলা চালালো, যারা নির্মমভাবে এক ছাত্রকে পিটিয়ে মারল, তাদের থেকেও বেশি ঘৃণা হচ্ছে এই ভারতী ঘোষের উপর। মুখ্যমন্ত্রী অধিকাংশ সময়েই ভুলে যান তিনি প্রশাসনিক প্রধান। শিক্ষামন্ত্রীও ভুলে যান তিনি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। আলটপকা মন্তব্য করা মোটামুটি অভ্যাসে পরিণত করেছেন। কিন্তু ভারতী ঘোষ, আপনি! তাঁদের না হয় তবু দলকে বাঁচানোর একটা দায় আছে। তাই দলীয় অবস্থান থেকেও সাফাই দিতে হয়। কিন্তু তাঁদের থেকেও বড় দায় যেন আপনার।
এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর পর এমন নির্লজ্জ প্রেস মিট কোনওদিন কোনও এসপি করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। একটি ছেলে মারা গেল। আগেরদিন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বলে বসলেন, ‘ছেলেটি দুবার ফেল করেছিল।’ একটি ছেলে খুন হল, তার সঙ্গে দুবার ফেল করার কী সম্পর্ক, মাথায় ঢুকছে না। ভাবতে লজ্জা হয়, এই মানুষটি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। এবার আপনি, ভারতী ঘোষ। আপনিও সেই দুবার ফেল করার তত্ত্ব টেনে আনলেন! দুবার ফেল করলেই তাকে কলেজের পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়। প্রেস মিটে আপনি কী বললেন ? ‘ওই ছেলেটি দুবার ফেল করেছিল। সে বহিরাগত। সে কী করে কলেজে ঢুকল, তার তদন্ত হবে।’ এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পর এমন কথা বলার আগে একবারও মনে হল না, এটা নিচুস্তরের অসভ্যতা হয়ে যাচ্ছে ? আর কী কী বললেন ? ‘যাদের বিরুদ্ধে এফ আই আর তাদের কাউকে লাঠি হাতে দেখা যায়নি।’ খুব জোর দিয়ে চারবার কথাগুলো বললেন। তাদের নির্দোষ প্রমাণ করার কী মরিয়া চেষ্টা! তৃণমূল জেলা সভাপতিও বোধ হয় নির্লজ্জের মতো এমন সার্টিফিকেট দিতে পারতেন না।
হ্যাঁ, এটা ঘটনা ছাত্র পরিষদের কর্মীরাও সেদিন নিরস্ত্র থাকেননি। তাদের হাতেও লাঠি ঠিল। বিভিন্ন ফুটেজে তাদেরও লাঠি হাতে দেখা গেছে। সেই কথা বলতেই পারতেন। আপনি আইপিএস। আইনটা নিঃসন্দেহে ভাল বোঝেন। কিন্তু কতগুলো সাধারণ ব্যাপার কিছুতেই আমাদের মাথায় ঢোকে না। ক্যামেরায় দেখা যায়নি বলেই তাদের হয়ে এমন জোরালো সওয়াল করতে হবে ? তার মানে, এবার থেকে সব খুন ক্যামেরার সামনে করতে হবে ? আপনি কি আশা করেছিলেন, যাঁরা লাঠি নিয়ে আক্রমণ করবে, তারা ক্যামেরায় পোজ দিয়ে ছবি তুলবে ? তারা সেই ছবি ফেসবুকে আপডেট দেবে ? তারা আপনার অফিসের সামনে লাঠি নিয়ে দেখিয়ে আসবে, দেখুন ম্যাডাম, আমরা লাঠি নিয়ে এসেছি। একটু আগে লাঠি দিয়ে একজনকে পিটিয়ে মেরে এসেছি ?
বিশ্বাস করুন, একজন আইপিএস এরকম দুর্বল যুক্তি দিতে পারে, এটা বিশ্বাস করতে এখনও মন চাইছে না। কেউ বললে হয়ত বিশ্বাস করতামও না। কিন্তু টিভিতে বারবার আপনার প্রেস কনফারেন্সের ফুটেজ দেখলাম। এরপর কী করে অবিশ্বাস করি ?
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বুঝে হোক, না বুঝে হোক, আলটপকা মন্তব্য করেন। এটা দীর্ঘদিনের রোগ। গতকাল তিনি ছিলেন শিলিগুড়িতে। সেখান থেকে কী শুনেছেন, জানি না। দুম করে বলে বসলেন, ‘ওখানে আমাদের ইউনিয়ন ছিল না। নিজেদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। ব্যাটের আঘাতে একটি ছেলে মারা গেছে।’ তিনি না হয় পুরোটা না জেনে বলে ফেললেন। পরের দিন আপনাকে সেটা প্রমাণ করতেই হবে। তাই মৃত ছাত্রর পরিবার এফ আই আর করতে গেল। আপনার পুলিশ সেই এফ আই আর নিল না (নিশ্চয় আপনার নির্দেশে)। এমন একটা নিন্দনীয় ঘটনা, গোটা রাজ্য তোলপাড়, তারপরেও তাঁর পরিবারের লোকেরা এফ আই আর করতে পারবেন না ? শাসক দলের এমন নির্লজ্জ স্তাবকতা করতে হবে ?
আমাদের মহাপুরুষদের উপর মাঝে মাঝে রাগ হয়। তাঁরা শিখিয়ে গেছেন, কাউকে ঘৃণা করতে নেই। তাঁরা আপনার মতো এমন চাটুকার পুলিশ অফিসার দেখেননি। যিশু থেকে মহাত্মা গান্ধী, সম্রাট অশোক থেকে তথাগত, সবাই ক্ষমা করুন। এই ভারতী ঘোষকে ঘৃণা করতে না পারলে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হবে।
প্রিয় পাঠক, সরকারের তরফ থেকে তাঁর হয়ত কিছু পুরস্কার প্রাপ্য। হয়ত পরে কখনও পাবেন। কিন্তু আমাদের তরফ থেকেও কিছু প্রাপ্য। সেই ঘৃণা উগরে দিতে আমরা যেন কোনও কার্পণ্য না করি।