রক্তিম মিত্র
গত এক বছরে সব থেকে বড় জল্পনা কী ? মুকুল রায় কবে দল গড়ছেন ? প্রায় রোজই কোনও না কোনও কাগজে মুকুলকে নিয়ে জল্পনা। এই বুঝি পুজোর আগে ছাড়লেন, এই বুঝি নভেম্বর বিপ্লব ঘটালেন। আর এই জল্পনাকে জিইয়ে রেখেছিলেন স্বয়ং মুকুল রায়ও।
তারপর সবথেকে বেশি আলোচনা হয়েছে কোন বিষয়টি নিয়ে ? কবে সরানো হচ্ছে রাহুল সিনহাকে ? তাঁর জায়গায় কি রূপা গাঙ্গুলি ? জুলাইয়েই কি রদবদল ? নাকি পুজোর আগে ? দীপাবলির আগে তো নিশ্চিত রাহুল বিদায়। দিনের পর দিন এভাবেই মিডিয়া বিদায় ডঙ্কা বাজিয়ে গেছে রাহুল সিনহার। কাগজ পড়লে বা টিভি দেখলে মনে হবে, এই বুঝি তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল।
গোটা রাজ্যে বোধ হয় তাঁর একজনও গুণমুগ্ধ নেই। যাঁরা ঘোরতর বিজেপি পন্থী, তাঁদের দাবি, রাহুল সিনহাকে দিয়ে কিছু হবে না। বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে গেলে নতুন মুখ দরকার। যাঁরা বিজেপি বিরোধী, তাঁদের কথায়, রাহুল সিনহা যতদিন থাকে, ততদিনই মঙ্গল। অন্য কেউ এসে গেলে পালে হাওয়া টেনে নেবে। আর সবজান্তা মিডিয়াকূল তো আছেই। রাহুল যে কার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন, কে জানে!
লোকসভা ভোটের পর এই রাজ্যেও একটা গেরুয়া ঝড় উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, তৃণমূল বিরোধী মূল শক্তি বিজেপি। তলার দিকে বাম শিবিরের অনেকেই নৌকো ভিড়িয়েছিলেন গেরুয়া বন্দরে। সবাই যে পদের লোভে বা উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে গিয়েছিলেন, এমনটা নয়। সেই সময় অনেকেরই মনে হয়েছিল, তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইটা হয়ত বিজেপি-ই লড়তে পারবে। তাই ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছিল।
সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই সেই হাওয়া স্তিমিত হয়ে গেল। সংগঠন না থাকলে শুধু হাওয়া দিয়ে যে বেশিদূর এগোনো যায় না, তা ক্রমশ পরিষ্কার হতে লাগল। আর যত রাজ্যের গালমন্দ জুটল রাহুল সিনহার। তাঁর জন্যই নাকি বিজেপির এই হাল। তিনিই নাকি এর জন্য দায়ী। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে রাজ্য নেতা, জেলা নেতা থেকে ব্লক নেতা- সবার এক সুর, রাহুল সিনহার বিদায় নিশ্চিত।
বিজেপি যে লোকসভায় ১৭ শতাংশে পৌঁছল, সে তো রাহুল সিনহার সময়েই। তারপরেও গ্রাফটা যেভাবে উঠছিল, তাও তো রাহুল সিনহার সময়েই। তাহলে সেই গ্রাফটা আবার হঠাৎ করে নেমে এল কেন ? কেন বিজেপি প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে ? নিচুতলায় কেন আবার বাম শিবিরে ফিরে আসার ঢল ? এর জন্য সত্যিই কি রাহুল সিনহাকে খুব বেশি দায়ী করা যায় ?
ভেবে দেখুন, কারা গিয়েছিলেন বিজেপিতে ? প্রকাশ্যে যাননি, অথচ বিজেপির প্রতি দুর্বল ছিলেন, তাঁরাই বা কারা ? তাঁদের অধিকাংশই তৃণমূল বিরোধী। তাঁদের মনে হয়েছিল, সিপিএম ঠিক লড়তে পারছে না। বিজেপি-র তাজা রক্ত, তার উপর কেন্দ্রে তাঁরা ক্ষমতায়। নেতারা রোজ নিত্যনতুন হুঙ্কার ছাড়ছেন। এই অবস্থায় বিজেপিই ভরসা। সারদা কেলেঙ্কারিতে একের পর এক নাম বেরিয়ে আসছিল। আজ একে ডাকা হচ্ছে, কাল তাকে ডাকা হবে, এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছিল সব জায়গায়। মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণের একটা বড় অংশজুড়ে শুধুই বিজেপি। যেন বাম নেই, বিজেপিই একমাত্র প্রতিপক্ষ।
তাহলে, সেই হাওয়া থমকে গেল কেন ? এখন অতিবড় বিজেপি কর্মীরাও বলতে পারেন না তাঁরা তৃণমূল বিরোধী। বরং উপর তলায় ঘনঘন যেসব বৈঠক হচ্ছে, তাঁরা বুঝে গেছেন, রাজ্যসভায় বিল পাস করাতে তৃণমূলকে লাগবে। তাই দিদিকে মোদি কিছুতেই চটাবেন না। সহজ কথা, এই রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতায় আসার বা নিদেনপক্ষে বিরোধী হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই দেখছেন না দিল্লি নেতৃত্ব। তাই দু চারটি আসন বাড়ানো জন্য তৃণমূলের সঙ্গে অহেতুক শত্রুতায় যেতে নারাজ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। প্রথম কয়েকমাস যে সংঘাতের চেহারা দেখা গিয়েছিল, সেটাই যেন ‘সৌহার্দ্যের বৈঠক’ হয়ে দাঁড়াল।
বিজেপি-র যে কোনও স্তরের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলুন। মোটামুটি একই সুর। সারদা তদন্ত যে কার্যত প্রহসন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, লোকদেখানো দু-একটা জেরা হবে, কিন্তু আসল মাথাদের নিয়ে নাড়াচাড়া হবে না, এটা মোটামুটি পরিষ্কার। অর্থাৎ, তাঁরা কট্টর তৃণমূল বিরোধী, এই ভাবমূর্তি আর বিজেপি-র নেই। তৃণমূলের নেহাত সংখ্যালঘু ভোটের বাধ্যবাধকতা আছে, নইলে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের জোটও হয়ে যেতেই পারত।
এতকিছুর মধ্যে রাহুল সিনহা কোথায় ? তিনি তো আর মোদিকে বলেননি দিদির সঙ্গে বৈঠক করতে। তিনি তো আর বলেননি সারদা তদন্ত ধামাচাপা দিয়ে দিতে। সহজ কথা, তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই মানুষ বিজেপিতে সামিল হয়েছিলেন। আবার তাঁরাই যখন দেখলেন, উপর তলা তৃণমূলকে চটাতে চাইছে না, সেই মোহভঙ্গে তাঁরা সরে গেছেন। এর জন্য রাহুল সিনহা যতটা না দায়ী, তার থেকে ঢের বেশি দায়ী মোদি-রাজনাথ-জেটলিরা।
রাহুল সিনহা নিজেও কারণটা বেশ ভাল করে জানেন। অথচ, সব অপবাদ তাঁকে হজম করতে হয়েছে। যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো যত ব্যর্থতা, সব দায় চাপানো হল রাহুল সিনহার উপর। সব বিষ নিজের কণ্ঠেই ধারণ করতে হল। বলতেও পারলেন না, আমার জন্য নয়, বিজেপির হাওয়া যদি কমে থাকে, তা দিল্লি নেতাদের জন্য। তাঁকে ‘নীলকণ্ঠ’ হয়েই থাকতে হবে।
বিদায়বেলায় অভিমান করে বলেই ফেললেন, আমি সরে যাচ্ছি, এবার আপনারা খুশি তো ? প্লিজ এবার অন্তত নতুন সভাপতিকে কাজ করতে দিন।
প্রিয় পাঠক, রাহুল সিনহাকে গালমন্দ করা খুব সহজ। এটাই প্রচলিত রীতি। কিন্তু সব ব্যর্থতার দায়ভার একা এই মানুষটার উপর চাপাবেন না।