বেঙ্গল টাইমস প্রতিবেদনঃ সকালটা যদি হয় স্বপনকান্তির, তবে বিকেলটা আরেক তরুণ বিধায়কের। সকাল থেকে বিধানসভা উত্তাল তৃণমূলের বিদ্রোহী বিধায়ককে ঘিরে। বিকেলে সভার ভেতর ঝড় তুললেন বামফ্রন্টের তরুণ বিধায়ক আলি ইমরান (ভিক্টর)। বুধবার ছিল রাজ্যপালের ভাষণের উপর বিতর্ক। সেই বিতর্কে অংশ নিয়ে অভিনব কায়দায় সরকারকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন। সরাসরি সমালোচনা নয়, বরং প্রশংসার মোড়কে কটাক্ষ। বিধানসভা সাক্ষী থাকল তরুণতম বিধায়কের অভিনব বাগ্মীতার। সেই বক্তৃতার নির্যাস তুলে ধরা হল বেঙ্গল টাইমসের পাঠকদের জন্য।
রাজ্যপালের ভাষণ সরকারের তৈরি করা ভাষণ, সেটাই নিয়ম। তাই এখানে সরকারের প্রশংসা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সরকারের এমন এমন কিছু সাফল্য আছে, যা সম্ভবত আর কোনও রাজ্যের নেই। সেই সাফল্যের দিকগুলি রাজ্যপালের ভাষণে খুঁজেই পেলাম না।
কোন কোন সাফল্যের কথা রাজ্যপালের ভাষণে নেই, তার কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরছি।
১) আমরা সবাই জানি, গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর নিজের দল কংগ্রেসই সেটা মেনে চলে না। বিজেপি তো মানেই না। কিন্তু আমাদের মুখ্যমন্ত্রী গান্ধীজির আদর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যাচ্ছেন রাজ্যের দাবি নিয়ে। কেজরিওয়াল তো শপথ নেওয়ার আগেই চলে গেলেন। শুনছি, নীতীশ কুমারও নাকি যাবেন। কিন্তু আমাদের মুখ্যমন্ত্রী একটাই কথা বোঝেন, অসহযোগ। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে কোনও মিটিংয়েই তিনি যাবেন না। তিনি কাউকে ভয় পান না। প্রধানমন্ত্রীকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে ঢোকানোর কথা কথা বলতে পারেন। এমন সাহসী মুখ্যমন্ত্রীর কথা রাজ্যপালের ভাষণে থাকবে না ?
এই অসহযোগকে তিনি নানা জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। সিবিআই হাড়ে হাড়ে বুঝেছে অসহযোগ কাকে বলে। কখনও সিবিআই অফিসে ধর্না। সেই ধর্নায় পাঠানো হয় আইনমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকারকে।
অভিযুক্তকে কোর্টে তোলা হলে আদালতে বিচারপতিকে কার্যত ঘেরাও করা হচ্ছে। আদালতের মধ্যেই বিচারপতিকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোর্টের মধ্যেই আইনজীবীদের হল্লা চলছে। বিচারপতিও হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, অসহযোগ কাকে বলে।
এখানেই শেষ নয়। দুদিন আগেই শোনা গেল, ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর জন্য রাজ্য প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। যার জেরে প্রকল্পটিই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর আগে কোনও রাজ্য সরকার এই কৃতিত্ব দেখিয়েছে ?
গান্ধীজির এই অসহযোগকে আমাদের রাজ্য এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এই মহৎ আদর্শের কথা রাজ্যপালের ভাষণে থাকবে না ?
২) স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাংলার বিরাট ভূমিকা। অনেকে জেল খেটেছেন। বাঙালি সেই ঐতিহ্যের কথা ভুলে যায়নি। এই সরকারের একজন মন্ত্রীও জেল খাটছেন। এর আগে আমাদের রাজ্য কোনও সরকারের কোনও মন্ত্রীর এই কৃতিত্ব নেই। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, সারা দেশেও এই নজির নেই। তাঁর জন্য ফুল ছোঁড়া হচ্ছে। পুলিশ তাঁকে স্যালুট করছে। নেতাজি আর কোনওদিন ফিরবেন কিনা জানি না। কিন্তু নেতাজির সঙ্গে এই মন্ত্রীর অনেক মিল। নেতাজির ভবানীপুরে বাড়ি ছিল, এই মন্ত্রীরও তাই। নেতাজি আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়েছিলেন, সেই আদর্শ থেকে এই মন্ত্রী তৈরি করেছেন ট্যাক্সি ইউনিয়ন। এমন একজন ‘নেতাজি’ এই সরকারের মন্ত্রী। এমন মহামানবের কথা রাজ্যপালের ভাষণে থাকবে না ?
৩) এই বাংলা রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, বিবেকানন্দের বাংলা। কিন্তু তার পর থেকে বাংলায় মহাপুরুষ পাওয়া যাচ্ছিল না। সম্প্রতি একটি সরকারি সার্কুলারে দেখলাম, নেতাজি আর বিবেকানন্দের ছবির মাঝে একই গুরুত্ব দিয়ে একজনের ছবি টাঙাতে বলা হয়েছে। বিবেকানন্দ ও নেতাজির সঙ্গে তুলনীয় একজন এই সরকারের নেতৃত্বে। এমন গৌরব আর কোন রাজ্যের আছে ? এই গৌরবের কথা রাজ্যপালের ভাষণে কিছুই নেই ?
৪) আমাদের সরকারের কান্ডারি রাজ্যের উন্নয়নের জন্য প্রচন্ড পরিশ্রম করেন। দশটা থেকে পাঁচটার রুটিন ডিউটি নয়, গভীর রাতেও তিনি রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কাজ করেন। এমনকি রাজ্যের পর্যটনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গভীর রাতেও কালিম্পঙের ডেলো বাংলোতে তিনি বৈঠক করেন। এমন পরিশ্রম, এমন উদ্যমের কথা রাজ্যপালের ভাষণে থাকবে না ?
৫) ছাত্ররা নাকি লেখাপড়া করছে না। এই নিয়েও ভেবেছে রাজ্য সরকার। সরকার জেনেছে, ছেলেরা লেখাপড়া না করে রাজনীতি করছে। তাই সরকার এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেন কলেজে ভোটাভুটি না হয় । কাউকে নমিনেশন তুলতেও দেওয়া হল না। কারণ, ভোটাভুটি হলেই ছাত্ররা তাই নিয়ে মেতে থাকবে। পড়াশোনার ক্ষতি হবে। এসব বোঝে বলেই এই সরকার কোথাও ভোট হতে দেয়নি। এমন ছাত্রদরদি সরকার আর কোন রাজ্যে আছে ? এই সাফল্যের কথা রাজ্যপালের ভাষণে নেই।
৬) অনেক সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা শিল্পপতিদের স্বার্থে চলছে। যেমন নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে আমরা অনেকেই বলি এটা ব্যবসায়ীদের সরকার। তৃণমূলও তাই বলে। কিন্তু আমাদের রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা যাবে না । কোনও এখানে যারাই শিল্প করতে আসেন, তাদের দায়িত্ব নিয়ে তাড়ানো হয়। সব কোম্পানি বুঝে গেছে, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। তাই তারাও আর এ মুখো হচ্ছে না। এত বড় সাফল্যের কথা রাজ্যপালের ভাষণে নেই ?
৭) আমাদের পুলিশ অত্যন্ত সক্রিয় । এমন প্রমাণ লোপাট করার প্রতিভা আর কারও নেই । সারদা কান্ডের প্রমাণ যেভাবে লোপাট করা হয়েছে, তা সারা দেশে দৃষ্টান্ত। সরকার দারুণভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমাদের পুলিশের তৎপরতা চমৎকার। যেই ইডি লকারের সন্ধান পেয়ে গেল, অমনি গভীর রাতে পুলিশ হানা দিল, রাতের বেলায় ম্যজিস্ট্রেটকে সই করিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে লকার খুলে ফেলল। আমাদের পুলিশ এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল, ইডি কিছু খুঁজেই পেল না। এই তৎপরতা আর কোন রাজ্যে দেখা যায় ?
৮) জেলার নাম আলিপুরদুয়ার। জেলা পরিষদে একটি দল মাত্র মাত্র একটি আসন পেল। কী অদ্ভুত সমীকরণ! সেই দলই জেলা পরিষদের ক্ষমতায়। গোটা দেশেও বোধ হয় এমন নজির নেই। আমার জেলা উত্তর দিনাজপুরও এই ম্যাজিক থেকে বঞ্চিত নয়। সেখানেও একটি দল মাত্র পাঁচটি আসন পেয়েছে। কিন্তু কোন যাদুমন্ত্রে বাইরে থেকে আরও দশজন জুটে গেল। গোটা পঞ্চায়েত, গোটা ব্লককেই গিলে ফেলার এক অদ্ভুত প্রতিভা। কটা রাজ্যে এমনটা দেখা যায় ? এমন কৃতিত্বের কথা রাজ্যপালের ভাষণে নেই ?
৯) দারুণ দারুণ সব কৃতী মানুষ জড়িয়ে আছেন এই সরকারের সঙ্গে। কেউ পুলিশের গাড়িতে বোম মারতে বলেন। কেউ বলেন, বাড়িতে ছেলে পাঠিয়ে দেব, রেপ করে দেবে। কেউ পুলিশকে চড় মারেন। কেউ মাঝরাতে গিয়ে শাসিয়ে আসেন। কেউ পুলিশকে পেটান। কেউ প্রিন্সিপালের দিকে জগ ছুঁড়ে মারেন। এমন সব প্রতিভা আর কোন রাজ্যে আছে ? এই কৃতী সন্তানদের কথা রাজ্যপালের ভাষণে থাকবে না ?।
১০) অন্য অনেক রাজ্যে নারী নির্যাতন হয়। সব রাজ্যেই হয়। আমাদের রাজ্য ব্যতিক্রম। এখানে একজন নারী গোটা রাজ্যকে নির্যাতন করেন।