সরল বিশ্বাস
বিধানসভায় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছি না। বিরোধীদের কিছু দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকে। কিন্তু সেই দায়িত্বশীল ভূমিকা বিরোধীরা পালন করছেন বলে মনে হয় না।
বাম জমানায় বিরোধীরা প্রায় প্রতি অধিবেশনেই একবার করে অনাস্থা আনতেন। ফলাফল যা হওয়ার, তাই হত। দেখা যেত, বিরোধীদেরই অর্ধেক সদস্য আসেননি। অর্থাৎ, বিরোধীদের পক্ষে যতগুলি ভোট পড়ার কথা, তার সত্তরভাগই পড়েনি। সংখ্যাটা বড় কথা নয়, নীতিগতভাবে অনাস্থা আনাই যায়। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে কেন ? এখনই কেন ?
মাত্র ছমাস আগে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার এসেছে। মানুষের রায় নিয়েই এসেছে। অন্যান্য ভোটে যতই রিগিং বা ছাপ্পা ভোট হোক, এবার বিধানসভায় তা হয়নি। বিরোধীরাও তেমন কোনও অভিযোগ করেননি। এই রায়কে মানুষের রায় বলেই মেনে নিতে হবে। ছমাস আগে যে সরকারটা এল, তারা এই ছমাসে রাতারাতি কী এমন খারাপ কাজটা করল যে এত তাড়াতাড়ি অনাস্থা আনতে হবে ? উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, যাঁরা দলত্যাগ করেছেন, তাঁদের হুইপ দেওয়া। তাঁদের হুইপ মানতে বাধ্য করানো। কিন্তু তার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা কেন ?
একজন এর মধ্যেই পাস কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি সরকারিভাবে বিধানসভা থেকে ছুটি চেয়ে নিয়েছেন। স্পিকার সেই ছুটি মঞ্জুরও করেছেন। তাঁর ক্ষেত্রে হুইপ কতটা কার্যকরি হবে, প্রশ্ন থেকেই যায়। বাকিরাও কোনও না কোনও অজুহাতে ঠিক পাস কাটিয়ে যাবেন। হয়ত অনুপস্থিত থাকবেন। স্পিকার চাইলে এই অনুপস্থিতির কারণ তলব করতে পারেন। কিন্তু এক বছর পর হয়ত সেই চিঠি যাবে। তার ছমাস পর তাঁরা উত্তর দেবেন, অসুস্থ ছিলাম। কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাবেন। কেউ আবার নার্সিংহোমের ভুয়ো বিল আগাম বানিয়ে রাখবেন। মোদ্দা কথা, যাঁদের টাইট দেবেন ভাবছেন, তাঁদের বিশেষ টাইট দেওয়া যাবে না। কারণ, স্পিকারের সমস্তরকম নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব তাঁদের সঙ্গেই থাকবে।
তার থেকে বরং অনাস্থাটা আনা উচিত ছিল স্পিকারের বিরুদ্ধে। পরিষদীয় ব্যবস্থায় স্পিকারের এত নির্লজ্জ ভূমিকা ভারতের কোনও রাজ্যে নেই। বর্তমানেও নেই, ইতিহাস ঘাঁটলেও পাওয়া যাবে না। একের পর এক, অধিকাংশ বাজেটই গিলোটিনে। আগের পাঁচ বছর প্রশ্ন করে উত্তরও পাওয়া যায়নি। দয়া করে একদিন বা দুদিন উত্তর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, তাও নিজের পছন্দের প্রশ্নে। অন্তত দশজন দলত্যাগ করেছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাজাপ্রাপ্ত বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাওয়ার কথা। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি ‘লোহাচোর’ এর পক্ষ নিয়েছেন। হাউসের মধ্যে মহিলা সদস্যকে মারধর করা হয়েছে, তিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়ে থেকেছেন। বিরোধী বিধায়করা বলতে উঠলেই হল্লাবাজদের চিৎকার, তিনি থামাতে পারেননি। মুলতুবি প্রস্তাব থেকে দৃষ্টি আকর্ষণী, পয়েন্ট অফ অর্ডার থেকে পয়েন্ট অফ ইনফর্মেশন, সব বিভাগেই মেরুদণ্ডহীনের মতো আচরণ করেছেন। আগের পাঁচ বছরে এই স্পিকারের বিরুদ্ধে একবারও অনাস্থা আসেনি কেন, সেটাই বিস্ময়ের।
নতুন বিধানসভাতেও সেই ধারা অব্যহত। একের পর এক দলবদল চলছে। দলত্যাগীরা ভালই জানেন, এমন স্পিকার থাকলে তাঁদের কোনও শাস্তি হবে না। তিনি তাঁদের আড়াল করতেই ব্যস্ত। সহজ কথা, স্পিকার হওয়ার কোনও যোগ্যতাই এই মানুষটির নেই। সরকার মানুষের রায়ে নির্বাচিত। কিন্তু এই স্পিকার খোদ তৃণমূলিদের কাছেই শ্রদ্ধেয় নন। শাসকদেলর বিধায়করাও জানেন, এই স্পিকারের মেরুদন্ড নেই। তাই অনাস্থা যদি আনতেই হয়, এই স্পিকারের বিরুদ্ধে আনুন।