স্বরূপ গোস্বামী
ধরা যাক, কোনও কলেজের অধ্যাপক। তাঁকে বাসে তুলে চালকের আসনে বসিয়ে দেওয়া হল। বলা হল, বাস চালাতে। কী হওয়ার কথা ?
ধরা যাক, একজন দাবা খেলোয়াড়। তাঁকে বলা হল ক্রিকেটে উইকেট কিপিং করতে। কী হওয়ার কথা ?
ধরা যাক, একজন উকিল। কখনও তিনি গান-বাজনার ধারেকাছেও যাননি। তাঁকে তুলে দেওয়া হল ডোবার লেন মিউজিক কনসার্টে। বলা হল সরোদ বাজাতে বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনাতে। কী হতে পারে ?
বা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁকে বল হল অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে বাইপস সার্জারি করতে। রোগীর কী অবস্থা হতে পারে ?
আপাতত চারটি উদাহরণ তুলে ধরা হল। এই জাতীয় উদাহরণ আরও বাড়ানোই যায়। মোদ্দা কথা, যাঁর যেটা কাজ নয়, তাঁকে সেই কাজ দিলে এমনটাই হয়। মেধা থাকলে, শেখার আগ্রহ থাকলে, পরে কিছুটা আয়ত্ব করা যায়। কিন্তু এই দুটোর কোনওটাই না থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ।
আমাদের বিধানসভার সেই দশা। পাঠশালার যিনি গুরুমশাই, তিনি হয় নিয়ম জানেন না। অথবা, জানলেও তা প্রয়োগ করতে ভয় পান।
সব কাজ যে সবাইকে দিয়ে হয় না, এটা আবার দিদিমণি বিশ্বাস করেন না। তাই মুনমুন সেন, সন্ধ্যা রায়দের এম পি বানিয়ে দেন। তাই, যাকে পারেন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার বানিয়ে দেন। ভাবেন, এটা বোধ হয় খুব সহজ কাজ। যে খুশি, সামলে দিতে পারে।
সক্রেটিসের একটি কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তিনি বলতেন, না জানাটা দোষের নয়। কিন্তু আমি কী জানি না, সেটা অন্তত আমি জানি।
গুরুমশাই আবার এটুকুও জানেন বলে মনে হয় না। শুরুতে জানতেন না, তবু তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যে দায়িত্বটা নিয়েছেন, পাঁচ বছরেও কিছু শিখলেন না ? পুরানো প্রসিডিংসগুলো কখনও পড়ে দেখেছেন ? দেখলে অন্তত বুঝতে পারতেন। যদি দেখেও থাকেন, তাঁর কাজে কোনও প্রতিফলন নেই।
রাজ্য সরকারের মোট দপ্তর সাতষট্টি। এর মধ্যে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হয়েছে মাত্র এগারোটি দপ্তরে। ছাপ্পান্নটি দপ্তরের বাজেট নিয়ে কোনও আলোচনাই হল না! একেবারে গিলোটিনে পাঠিয়ে দেওয়া হল !
এবারই প্রথম নয়। আগের পাঁচ বছরেও ছবিটা মোটামুটি একই রকম। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, তথ্য সংস্কৃতি, সংখ্যালঘু উন্নয়ন, পঞ্চায়েত, ভূমি সংস্কার, কৃষি – এসব গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের বাজেট নিয়ে আলোচনা হবে না ? প্রতিবারই অধিকাংশ দপ্তর বাদ পড়েছে আলোচনা থেকে। বিধানসভার কাজকর্ম সম্পর্কে যদি ন্যূনতম ধারণাও থাকে, তাহলে এটা করা যায় ? কথায় কথায় বাম জমানার চৌত্রিশ বছরের কথা উঠে আসে। এইসব গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়নি, এমন দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবেন ? বড়জোর সময় কম থাকলে নিতান্ত গুরুত্বহীন দু-একটা দপ্তর হয়ত বাদ পড়েছে। সেটাও বিরোধী দলের সম্মতি নিয়ে। আর এখানে! কী অবলীলায় ষাতষট্টি দপ্তরের মধ্যে ছাপ্পান্ন দপ্তর আলোচনা ছাড়াই গিলোটিনে পাঠিয়ে দেওয়া হল। পরিষদীয় রাজনীতি সম্পর্কে যাঁদের সামান্য ধ্যানধারণা আছে, তাঁরা জানেন, এটা কতটা লজ্জার। আর যাঁরা ছাপ্পান্নখানা বাজেট গিলোটিনে পাঠানোর পক্ষে যুক্তি সাজতে চাইবেন, তাঁদের কী বলা যায় ?
বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে। সব বাজেটই ধ্বনি ভোটে পাস হয়ে যাওয়ার কথা। তাও আলোচনায় এত ভয় ? আসলে, এটা যে কতটা লজ্জাজনক, সেই বোধটাই নেই। কেউ হেলমেট না নিয়ে গাড়ি চালালেও অপরাধ, ধর্ষণ করলেও অপরাধ। দুটো অপরাধকে যে সমান করে দেখে, তাকে শিক্ষিত বা বিচক্ষণ বলা যায় ? যদি কোনও বিচারক এই দুটো ক্ষেত্রে একইরকম শাস্তি দেন, তাহলে তাঁর বিচারকের চেয়ারে বসার কোনও যোগ্যতা আছে ?
এটা নিছক সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ। গত পাঁচ বছরে বিধানসভার কার্যক্রম দেখতে গেলে এমন উদাহরণ অন্তত পঞ্চাশখানা হাজির করা যায়। প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি প্রমাণ করেই ছেড়েছেন, এই চেয়ারে বসার কোনও যোগ্যতাই তাঁর নেই।