রবি কর
ছোটবেলায় আমরা পড়েছি, “বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।” ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় একদিন নিশ্চয়ই খুব বড় হবেন, তাই তিনি এতদিন ছোট হয়ে ছিলেন। মানে কেবলমাত্র ছাত্রদের নেতা হয়ে ছিলেন।
আমাদের ঋতব্রত, কলেজের গণ্ডী পার করলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পেরলেন, বিয়ে-থা করে সংসারী হলেন, লোকসভা ভোটে লড়লেন, হারলেন, শেষমেশ রাজ্যসভার ভোটে জিতে এম পি হলেন। তবু ছাত্রনেতার পদ তিনি ছাড়ছিলেন না। শুনেছি পণ্ডিত লোকেরা সারাজীবন ছাত্র থেকে যায়। কিন্তু সারাজীবন কেউ ছাত্রনেতা থাকে এমনটা শুনিনি। ঋতব্রত বোধহয় সেই নজির গড়বেন ঠিক করেছিলেন।
সেই কবে ১৯৯৬-৯৭ সাল নাগাদ ঋতব্রতর ছাত্র রাজনীতি শুরু হয়েছিল। তারপর জীবন চলিয়া গেল কুড়ি কুড়ি বছরের পার। ১৯৯৬-৯৭ তে যে শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল, আজ সে কলেজের ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। অর্থাৎ গোটা ছাত্রজীবন ধরে সে জানল তার নেতার নাম ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়তো সে মনে মনে স্লোগানও দিত, জব তক সুরজ চাঁদ রহেগা, ঋতব্রত ছাত্রনেতা রহেগা।
কিন্তু না, দলীয় নেতৃত্বের এক বেয়াক্কেলে সিদ্ধান্তে আমাদের সেই আশা পূর্ণ হল না। সম্প্রতি ঋতব্রতকে ছাত্র ফ্রন্ট থেকে সরিয়ে যুব সংগঠনে নিয়ে আসা হয়েছে। ওগো আমার কি হবে গো, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ঋতব্রত যদি যুবক হয়ে যায়, তাহলে তো একদিন বুড়ো হয়ে যাবে গো। ওগো আমি তো ভেবেছিলাম, আমার ছোট শালীর হামাটানা ছেলেটা ঋতব্রতর নেতৃত্বে ছাত্র রাজনীতি করবে গো।
আচ্ছা এই দীর্ঘদিনের ছাত্র রাজনীতিতে ঋতব্রত কী কী করলেন? তৃণমূলীরা বলে, দলবল নিয়ে অমিত মিত্রের উপরে হামলা করা ছাড়া কিছুই করেনি। পদ্মমূলীরা বলে, প্রকাশ্যে গরু খাওয়া ছাড়া কিছুই করেনি। যারা ‘কমred’ তারা বলে, রাজ্যসভায় কঠিন কঠিন ভাষণ দেওয়া ছাড়া কিছুই করেনি। আর যারা ‘বেশিred’ তারা বলে, ঋতব্রত নব্য বামপন্থা বা neo-communism–এর প্রচার করছিলেন।
এই নব্যধারার বামপন্থায়, রেডবুকের থেকে ফেসবুককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই বামপন্থায় দেওয়াল লিখন একেবারে নিষিদ্ধ। লেখালিখি যা হবে wall-এ , মানে ফেসবুকে। হাটে মাঠে ঘাটে বক্তব্য না রেখে, গ্রুপে-পেজে বক্তব্য রাখা হয়। এতে সুবিধা অনেক। রোদে জলে কষ্ট করতে হয় না। শাসক দলের গুন্ডাদের মার খেতে হয় না। বড় জোর ট্যারাবেঁকা কমেন্ট পড়ে। জনসভায় কষ্ট করে লোক জোগাড়ও করতে হয় না। লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনসংযোগ করতে হয় না। শুধু কষ্ট করে লিখে ফেল্লেই হল। লেখা নিজে থেকে বাড়ি বাড়ি চলে যাবে।
ভালোই চলছিল। মুশকিল করছে বিমান-সূর্যর মতো বুড়োগুলো। তারা এই বয়সেও জেলায় জেলায় জ্যাঠা বের করছে। মাইলের পর মাইল হাঁটছে। তাই দেখে কোনও কোনও হতভাগা বলছে, “গ্রামে না যাস অন্তত কলেজে যা। যে কলেজে এস এফ আই নমিনেশন জমা দিতে পারছে না, সেখানে ঋতব্রত গিয়ে দাঁড়াক।“ তারপর নমিনেশন জমা দেওয়া গেলে ঋতব্রতর লাভ, আর যদি মার খেতে হয় তাতেও ঋতব্রতর লাভ। কালীঘাটের একজন তো মার খেয়ে খেয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেলেন।
অবশ্য আমরা জানি ঋতব্রতও মন্ত্রী হবেন, শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থাটা একটু পাল্টাতে হবে। ই.ভি.এমের বদলে ফেসবুকে ভোট হবে, ভোটার লিস্টের বদলে ফ্রেন্ডলিস্টে ভোটারদের নাম তুলতে হবে। প্রার্থীরা নিজের নিজের বক্তব্য পোস্ট করবে। যে বেশি লাইক পাবে সে হবে বিজয়ী। কেউ ভুল করে কমেন্ট লিখলে তার ভোট বাতিল হবে।
একবার এই ব্যবস্থা চালু করে দেখুন, কারও সাধ্য নেই ঋতব্রতকে হারায়। ডেরেক-পেরেক কেউ পেরে উঠবে না। কিন্তু যতদিন না ওসব ব্যবস্থা চালু হয়, ততদিন বিমানদারা খেটে মরুক। আমরা বরং ঋতব্রতর টুইটার ফলো করি।