রবি কর
আমার পড়াশোনা বেশি দূর নয়। ভালো লিখতেও পারি না। তবু সাংবাদিকতা করে খেতে পারি কারণ আমার কান দুটো কুকুরের মতো সজাগ। কে কোথায় কি বলছে, সব আমার কানে এসে ঢোকে। ছোটবেলায় বাবা বলত, “সব কথায় কান দিস বলেই পড়াশোনায় তোর মন বসে না।“ বউ বলে, “তোমার স্বভাব টিভি সিরিয়ালের কূট চরিত্রগুলোর মতো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে শোনো কে কী বলছে।“ bengaltimes-এর এডিটর বলে, “রবিবাবু আপনাকে দিয়ে তো কোনও কাজ হয় না। যান রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। যেখানে যা শুনবেন, আমাকে এসে বলবেন।”
এডিটরের নির্দেশ মতো এই মানুষ-মারা গরমে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। কলকাতার দক্ষিণে একটা বেহাল জায়গা আছে। গতকাল সেখানে গেছিলাম। একটা চা দোকানে ঘাপটি মেরে বসে আছি। গোপন কথা শোনার সবথেকে ভালো জায়গা এই চা দোকান। কিন্তু এই গরমে দোকানে কোনও লোকই আসছে না। তাই কোনও কথাও শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ শুনি সামনের বাড়ি থেকে এক মহিলার চিৎকার। চিৎকার করে তিনি কাউকে শাসাচ্ছেন। বলছেন, “ঘাসের মাঠে ক্রিকেট খেলে তোমার পোষায় না? বালির মাঠে ক্রিকেট খেলতে গেছো?”
দোকানদারকে বললাম, “ও মশাই বালিতে ক্রিকেট খেলা যায় না কি? বল তো ড্রপ খাবে না।” দোকানদার বলল, “আরে এ বালি সে বালি না। চুপচাপ শুনে যান। অনেক খবর পাবেন।” কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম। ভদ্রমহিলা বলছেন, “অনেকদিন থেকে দেখছি, ওই ডালুর মেয়েটার দিকে তোমার নজর। হবে না? ওর বাবার কাছ থেকে অনেক উপকার পেয়েছ যে।” একটা পুরুষ কণ্ঠে আমতা আমতা করে জবাব এলো, “কেন? এর আগে ভোটের সময় আমি তো ডালুবাবুর বিরোধিতা করেছিলাম।”
মহিলা বলল, “হ্যাঁ করেছিলে। কারণ তখন বুদ্ধুকে খুশি করতে চেয়েছিলে। আর বুদ্ধুকে খুশি করতে গিয়ে ডালুবাবুর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছিল। তাই ওই মেয়েটার সঙ্গেও আর দহরম মহরম ছিল না। আমি ভেবেছিলাম, রোগ বোধহয় সেরে গেছে। কিন্তু ডালুবাবু মারা যেতেই আবার নতুন করে শুরু হয়েছে।“ পুরুষকণ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, “কেন? কী করেছি আমি?”
“আবার বলছ কী করেছি? পার্কে, গলিতে যে ছেলেরা ক্রিকেট খেলে, তারাও কম করে ১০ ওভারের ম্যাচ খেলে। আর তুমি বুড়ো বয়সে ৫ ওভারের ম্যাচ খেলতে গেলে? তাও পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোথাও নয়? ওই মেয়েটা যেখানে বলল সেখানে? আচ্ছা যদি তোমাকে কেউ বালিগঞ্জে ৫ ওভারের ম্যাচ খেলতে বলে, যাবে? তাহলে ওখানে গেলে কেন? ২৯৪টা জায়গার মধ্যে ওটাই তোমার পছন্দ হল? একে বৈশাখ মাস। এই রোদে কুকুরও বাড়ি থেকে বেরোয় না। আর তুমি কিনা সাধের বৈশাখীর ডাকে ছুটলে ক্রিকেট খেলতে!”
দোকানদারকে বললাম, “কী ব্যাপার বলুন তো? আমি তো কিছুই বুঝছি না।” দোকানদার খেপে গিয়ে বলল, “ মশাই বোঝবার জন্য মাথায় একটু বুদ্ধি থাকা দরকার। আপনার সেটা নেই। ওই মহিলার স্বামী এককালে ডালুবাবুর স্নেহধন্য ছিলেন। কিন্তু ডালুবাবুর সঙ্গে বুদ্ধুবাবুর যখন ঝামেলা লাগল, তখন তিনি বুদ্ধুবাবুর পাশে দাঁড়ালেন। এখন বুদ্ধুবাবুর সময় খারাপ যাচ্ছে। ডালুবাবুর মেয়ে বুদ্ধুবাবুকে টাইট দিতে চাইছেন। ওই মহিলার স্বামীও বুদ্ধুবাবুর পাশ থেকে সরে গেছেন।”
“কিন্তু এতে ওই মহিলা খেপে গেছেন কেন?”
“ওই মহিলার স্বামীর সঙ্গে ডালুবাবুর মেয়ের ইয়ে আছে বলে একটা খবর রটেছিল। মহিলা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ডালুবাবুর মেয়েকে ঝাঁটাপেটা করবেন। ব্যাপারটা থিতিয়ে গেছিল। কিন্তু ডালুবাবুর মেয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে ওই মহিলার স্বামী ৫ ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে গেছে। ব্যস আর যায় কোথায়!”
“কেন এতে দোষের কী আছে? ভদ্রলোক হয়তো ভালো ক্রিকেট খেলতে পারেন না। তাই ৫ ওভারের ম্যাচই খেলেন।”
“দূর মশাই, আপনি দুনিয়ার কোনও খবরই রাখেন না। আপনি উঠুন তো আমার দোকান থেকে,” বলে দোকানদার আমাকে এক ধাক্কা দিল।
ধাক্কা খেয়েই ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি দোকানদার বলছে, “মশাই দুপুরবেলা বেঞ্চিতে বসে আর ঢুলতে হবে না। বাড়ি যান। আমি এবার দোকান বন্ধ করব।”
সত্যি ঘুমের ঘোরে কী সব স্বপ্ন যে দেখছিলাম! আপনারা আর একবার প্রথম থেকে পড়ে দেখুন তো, এর কোনও মাথামুণ্ডু আছে কি না!