দিব্যেন্দু দে
ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথা বলার আগে একটু মহাভারতের কথা বলে নিই।
গুরু দ্রোণাচার্যের প্রিয় শিষ্য ছিলেন অর্জুন। তিনি ছিলেন মহা বীর। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ। তিনি বিশ্বজয়ের ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু ধর্মরক্ষার জন্য বনে বনে ঘুরেছেন। বৃহন্নলার জীবন-যাপন করেছেন।
অনার্য তরুণ একলব্য দ্রোণাচার্যর শিষ্য হওয়ার সুযোগ পাননি। কিন্তু মনে মনে তাঁকেই গুরুপদে স্বীকার করে একলব্য অস্ত্রসাধনা করেছিলেন। তিনিও ছিলেন মহাবীর ।
কিন্তু দ্রোণাচার্যের নিজের পুত্র অশ্বত্থামা? তিনি ছিলেন একটি অপোগন্ড। দ্রোণ তাঁকে সব শিক্ষাই দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বীর হলেও অশ্বত্থামার ধর্মচেতনা ছিল না। তাই মহাভারতের যুদ্ধে তিনি কোনও কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। বরং, পঞ্চপাণ্ডবের সন্তানদের ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে অশ্বত্থামা নিজের নাম কলঙ্কিত করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন লোভী, শাসকের উচ্ছিষ্ট পাওয়ার লোভে তিনি কৌরবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। দুর্যোধনের যাবতীয় কু-কর্মের সমর্থক ছিলেন তিনি।
এবার ডেরেক ও’ব্রায়েনের পিতার কথায় আসি।
আমরা যারা, আশি নব্বইয়ের দশকে নিয়মিত আনন্দমেলা পড়েছি, তাদের কাছে নিল ও’ব্রায়েন ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় মানুষ। তিনি আনন্দমেলার প্রতি সংখ্যায় কুইজের কলাম লিখতেন। তখন ইন্টারনেট ছিল না। উইকিপিডিয়া ছিল না। নিল ও’ব্রায়েন ছিলেন আমাদের জীবন্ত বিশ্বকোষ। জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখাপ্রশাখায় তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ।
নিল ও’ব্রায়েনের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই, শিক্ষার শেষ নেই। কত অজানা বিষয়, অজানা তথ্য তাঁর থেকে জেনেছি। তাই আমরা অনেকেই তাঁকে গুরু বলে মেনেছিলাম। সামনাসামনি কখনও তাঁকে দেখিনি। তাই একলব্যের মতো দূর থেকেই তাঁকে বর্ণনা করেছি। তিনি ছিলেন আমাদের দ্রোণাচার্য।
এবার ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথায় আসি। বোর্নভিটা কুইজ কনটেস্ট নিয়ে ডেরেক যখন টিভির পর্দায় এলেন, আমরা উল্লসিত হয়েছিলাম। বাংলা, হিন্দি, ইংরাজিতে সমান সাবলীল। অসাধারণ বাকপটু, স্মার্ট, সুদর্শন, জ্ঞানী। সাবাশ বাপ কা বেটা। শুধু ব্যাটা নয়, শিষ্য। দ্রোণাচার্যের শিষ্য অর্জুন। নিল ও’ব্রায়েনের শিষ্য ডেরেক ও’ব্রায়েন।
ডেরেক তৃণমূলে যোগ দিলেন। দিতেই পারেন। এ ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। কিন্তু ডেরেকের মতো জ্ঞানী লোক টিএমসি-তে ? একটু খটকা লেগেছিল। ডেরেক তৃণমূলের মুখপাত্র হলেন। হতেই পারেন। এ ব্যাপারে পূর্ণ যোগ্যতা তাঁর আছে। কিন্তু ডেরেক তৃণমূলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারবেন তো ? একটু খটকা লেগেছিল।
কিন্তু কালে কালে দেখা গেল, খটকা লাগার কোনও কারণ নেই। ডেরেক শুধু তৃণমূলের সঙ্গে মানিয়ে নেননি, তৃণমূলি মিথ্যাচারে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন তিনি। গতকাল আমরা দেখলাম, নিল ও ব্রায়েনের কুইজ মাস্টার ছেলে সাংবাদিক সম্মেলন করে বুক বাজিয়ে মিথ্যাচার করছেন, ভুল তথ্য পরিবেশন করছেন।
বাম-বিজেপি ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ দেওয়ার জন্য তিনি সাংবাদিকদের একটি ছবি দেখিয়েছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, রাজনাথ সিং প্রকাশ কারাতকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। পরে প্রমাণ হল, ছবিটি জাল, ফটোশপ করা। আসল ছবিতে ছিল, রাজনাথ সিং মোদিকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। হায় নিল ও ব্রায়েন, আপনার পুত্রের এমন অবনতি ?
হায় ডেরেক ও’ব্রায়েন, হায়। আপনি প্রমাণ করলেন, আপনি অর্জুন নন। একলব্য নন। আপিন অশ্বত্থামা। আপনি ধর্মচ্যূত।আপনি মিথ্যাচারি। উচ্ছিষ্টের লোভে আপনি শাসকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তাদের প্রতিটি পাপ কার্যে সমর্থন করেছেন। না জেনে ভুল বললে পাপ হয় না। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি জেনেশুনেই ভুল বলেছেন। নিল ও’ব্রায়েনের পুত্র সমগ্র সৌরমণ্ডলের খবর রাখতে পারে। আর আসল ছবি-নকল ছবির তফাত বুঝতে পারে না ? এ কখনও সম্ভব ? আসলে ডেরেক ও’ব্রায়েন আর তথ্যের কাছে দায়বদ্ধ নন, তিনি দিদির কাছে দায়বদ্ধ।
শুনুন ডেরেক, অশ্বত্থামার পাপ কাজের জন্য দেবতারা তাঁকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তাঁর সব অস্ত্র, সব শৌর্য কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ বলে, তাঁর সর্বাঙ্গে পচন ধরেছিল। ডেরেক, আপনারও সব শক্তি ক্রমে ক্রমে অপহৃত হচ্ছে। চিন্তায়, চেতনায় পচন ধরছে। তাই জাল ফটো নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করতে আপনার বিবেকে বাধছে না।
একটা পাড়ার ক্লাবের মুখপাত্রও কাউকে কিছু বলার আগে তথ্য যাচাই করে নেয়। আপনার সেই বোধ-বুদ্ধিও লোপ পেয়েছে। অবশ্য তৃণমূলের মুখপাত্র হতে গেলে, বোধ বুদ্ধি লাগে না। এঁড়ে তর্ক করতে পারলেই হয়। কিন্তু এঁড়ে তর্ক করার জন্য আপনি কেন ? এ কাজ তো শঙ্কু পন্ডা অথবা আরাবুলও করতে পারে। প্রিয় ডেরেক, তৃণমূলের মুখপাত্রের পদ ছেড়ে দিয়ে ওই পদে শঙ্কু-আরাবুলকেই বসান। অথবা স্বীকার করুন, দিদির রাজত্বে নিল ও’ব্রায়েনের পুত্র আর আরাবুলের কোনও তফাত নেই।
পুনশ্চঃ ডেরেকবাবুর বোর্নভিটা কুইজ কনটেস্ট আজকাল লাটে উঠেছে। শুনেছি দলবল নিয়ে তিনি সোশাল মিডিয়ায় তৃণমূল বিরোধী পোস্ট খুঁজে বের করেন। এবং সেগুলিকে ব্লক করেন। হয়ত এই পোস্টটাও ব্লক করা হবে। কিন্তু আসল কথাটি গোপন থাকবে না প্রিয় কুইজ মাস্টার। কথাটি হল—
নিল ও ব্রায়েনের পুত্র অর্জুন নন। একলব্যও নন। তিনি অশ্বত্থামা।