আলি ইমরান (ভিক্টর)
গত কয়েকদিন আমরা সবাই যেন মেতে আছি আবেশের মৃত্যু নিয়ে। সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল একটি মৃত্যু। কিন্তু সেটাকে নিয়ে যে প্রচার চলছে, তা সত্যিই খুব বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। শোক জানানোর নামে আমরা বোধ হয় সব যুক্তি-বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিচ্ছি। কে মালা দিতে যাবে, কে ছবি নিয়ে মোমবাতি মিছিল করবে, তার কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে।
মুখ্যমন্ত্রীও আবেশের পরিবারকে আশ্বস্ত করলেন, তদন্তের শেষ দেখে ছাড়বেন। শোকসন্তপ্ত পরিবারের কেউ দেখা করতে গেলে হয়ত এভাবেই সান্ত্বনা দিতে হয়। তদন্তে কী বেরিয়ে আসবে ?আবেশের মৃত্যু দুর্ঘটনা ছিল নাকি খুন ছিল ? যে সত্যই উঠে আসুক, আসল সত্য সেই চাপা পড়ে যাচ্ছে। প্রশ্নটা শুধু একটা আবেশকে নিয়ে নয়। এমন হাজার হাজার আবেশ প্রতিদিন নিশব্দে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার একটাই উপায়- এই রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করা।
গত মাসে বিধানসভায় বিষয়টা নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলাম। তারপর থেকে যে সাড়া পাচ্ছি, নিজেরই মনে হচ্ছে, এমন একটা জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে আগে কেন সোচ্চার হইনি। রাজ্যে সাম্প্রতিককালে যতগুলি অপরাধ হয়েছে, একটু তলিয়ে দেখুন। প্রায় সবকটির পেছনেই একটি কমন উপাদান- সেটি হল মদ। খুন থেকে ধর্ষণ, দুর্ঘটনা থেকে রাজনৈতিক হিংসা। অনিবার্য উপাদান সেই মদ। এই সহজ সত্যিটা কেন রাজ্য সরকার বুঝতে পারছে না ?
আমার বিহার সীমান্তে বাড়ি। কলকাতা আসতে গেলে কিশানগঞ্জ থেকেই ট্রেন ধরতে হয়। ছোট থেকেই ওই শহরেই বেড়ে উঠেছি।মাত্র কয়েকমাসে ছবিটা যেন বদলে গেছে। যে বিহারিদের দেখে আমরা হাসাহাসি করতাম, আজ তারা আমাদের দেখে হাসাহাসি করে। সস্তায় মদ পাওয়া যাবে বলে আগে আমাদের এলাকার লোক বিহার সীমান্তের ওপারে মদ খেতে যেত। এখন উল্টো ছবিটা দেখা যাচ্ছে। ওপারের মাতাল বাংলায় এসে মাতলামি করে যাচ্ছে। কারণ, এখানে মদ ও মাতলামি দুটোই বৈধ। বিহার যদি নিজেদের শুধরে নিতে পারে, আমরা পারি না ?
বিষয়টা বিধানসভায় তোলার পর থেকে নানা জায়গা থেকে সমর্থন পাচ্ছি। এমনকি তৃণমূলের মন্ত্রীরাও গোপনে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। গ্রাম বাংলার ছবিটা কী ভয়ানক হয়ে উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রী হয়ত ভাবতেও পারছেন না। অধিকাংশ বাড়িতে এই মদকে ঘিরে অশান্তি। দাম্পত্যের মাঝে, বাবা-ছেলের সম্পর্কের মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই মদ। অনেক পরিবার সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক ছেলের লেখাপড়ার সলীল সমাধী ঘটছে এই একটি জিনিসের জন্য। শুধুমাত্র কিছু রাজস্বের জন্য সরকার এটাকে প্রশ্রয় ও উৎসাহ দিয়ে যাবে ?
টিভি চ্যানেল বা কাগজে যখন সবকিছুই আবেশময়, তখন ভেতরের পাতায় ছোট্ট একটি খবর- মদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এক গ্রাম্য গৃহবধূ হাসপাতালে। শহুরে বুদ্ধিজীবীদের বলতে ইচ্ছে করে, এখানে আবেশের মৃত্যুর জন্য মোমবাতি মিছিল না করে ওই মহিলার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। আবেশ বা তার বখাটে বন্ধুরা নয়, এই সমাজের রোল মডেল হতে পারেন ওই গ্রাম্য গৃহবধূ। আপনি কোনদিকে ? ওই মহিলার বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের দিকে ? নাকি বাপ-মায়ের টাকায় একদল ছেলের উচ্ছৃঙ্খলতার দিকে ? একটা স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার সময় এসে গেছে।
বিধানসভায় আমি সমালোচনায় সোচ্চার হই। তাই মুখ্যমন্ত্রী আমাকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, গ্রাম থেকে মফস্বল, ছোট শহর থেকে মহানগর, অধিকাংশ পরিবারে অসহায় এক কান্না। আপনি সেই নির্যাতিত নারীদের মুখ্যমন্ত্রী নাকি তাদের মাতাল স্বামীদের মুখ্যমন্ত্রী ? আজ একটা কঠিন পথ বেছে নিতেই হবে। বিহারের মতো রাজ্য যদি পারে, আমরা কেন পারি না ?
আবেশ দুর্ঘটনার শিকার নাকি খুন, সে তদন্তের তেমন গুরুত্ব নেই। কেন আবেশরা বিপথগামী হয়ে উঠছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। একজন আবেশ হারিয়ে গেছে। আরও অনেক আবেশকে যে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
(লেখক একজন বিধায়ক। বিধানসভায় মদ নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছিলেন। ফের সেই দাবি করে কলম ধরলেন বেঙ্গল টাইমসে।)