রক্তিম মিত্র
মিথ্যে বলা একটা মস্তবড় রোগ। যে এই রোগে আক্রান্ত, তার পক্ষে সত্যি বলাটা কঠিন। ইচ্ছে না থাকলেও দু–চারটে মিথ্যে ঠিক বেরিয়ে যাবে। অভ্যেস।
প্যানিক ছড়ানো একটা রোগ। ছোট থেকেই এই রোগ দেখা যায়। অল্প কিছু হলেই হইচই বাঁধিয়ে দেওয়া। হয়ত প্রচারে থাকার জন্য। হয়ত বাড়তি গুরুত্ব পাওয়ার জন্য। সূর্য পূর্বদিকে উঠলেও তাঁরা হয়ত চক্রান্তের গন্ধ খোঁজেন। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলেন। অভ্যেস।
বেশি বয়সে এই অভ্যেস আর ছাড়ানো যায় না। থেকেই যায়। কিন্তু এই রোগ ছড়িয়ে গেলে তো আরো মুশকিল। তখন সেটা আরও ভয়াবহ। কাগজের খবর, অভিষেক ব্যানার্জি জেড ক্যাটাগরি নিরাপত্তা পাবেন। তিনি যেখানে যাবেন, চারটি পাইলট থাকবে। কুড়িজন কমান্ডো থাকবে। ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে সেখানে কুকুর ঘুরঘুর করবে। রাস্তায় থাকবে পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী। যাঁরা সাংবিধানিক বড় বড় পদে থাকেন, তাঁদের জন্য এমন ব্যবস্থা থাকে। এবার সেই তালিকায় এসে গেলেন অভিষেক ব্যানার্জিও।
তাঁর একটা সরকারি পরিচয় আছে, তিনি ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। এর বাইরে সবথেকে বড় পরিচয়, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো। তিনিই এর–তার হাতে দলের পতাকা তুলে দিচ্ছেন। তিনিই ক্ষমতার দ্বিতীয় মুখ। তিনিই পিসির সম্ভাব্য উত্তরসূরী। গান্ধী পরিবার নিয়ে আমরা অনেক সমালোচনা করি। পরিবারতন্ত্রই সেখানে একমাত্র যোগ্যতা। বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূলও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। বরং আরও উগ্রভাবে পরিবারতন্ত্র এখানে থাবা বসিয়েছে। দলের ভেতর বা বাইরে যে যতই ক্ষুব্ধ হয়ে থাকুন, টুঁ শব্দটি করার উপায় নেই। করলেই গর্দান যাবে।
অতীতে জ্যোতি বাবুর ছেলেকে নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। সেই সমালোচনায় রঙ চড়ানো হয়েছে ঠিকই, তবে সেই সমালোচনা একেবারে অযৌক্তিকও ছিল না। সেই সমালোচনায় সবথেকে সোচ্চার ছিলেন আজকের যিনি মুখ্যমন্ত্রী, তিনি। জ্যোতিবাবু অন্তত দলটাকে বা সরকারটাকে পারিবারিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেননি। জ্যোতিবাবুর পুত্র অন্তত দলের নেতাদের উপর খবরদারি করেননি। নম্বর টু হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। জেড প্লাস তো দূরের কথা, কোনও সরকারি নিরাপত্তাও চাননি।
আচ্ছা অভিষেক, আপনি তো এই প্রজন্মের যুবক। বাইরে পড়াশোনা করেছে। শিক্ষিত, এরকম একটা প্রচার আছে। আপনার মনে হয় না আপনার জেড প্লাস ক্যাটাগরি নেওয়া উচিত নয়। রাজ্যে লোকসভায় আরও তো ৪১ জন সাংসদ আছেন (রাজ্যসভায় আরও ১৬, মোট ৫৮) । বিয়াল্লিশজন মন্ত্রী আছেন। কই, তাঁরা তো জেড প্লাস নন। হঠাৎ আপনি কেন জেড প্লাস ? যতই পুলিশের নিরাপত্তা বিষয়ক রিভিউ কমিটির দোহাই দেওয়া হোক, সহজ কথা, আপনার পিসি চেয়েছেন, তাই আপনি জেড প্লাস।
কয়েকদিন আগে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মধ্যে আপনি পড়েছিলেন। আমরা, আপনার সমালোচকরাও চেয়েছিলাম, আপনি দ্রুত সেরে উঠুন। সেই চাওয়ার মধ্যে কোনও ভনিতা বা সস্তা নাটক ছিল না। আপনার দলের লোকেরা যতটা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন, এই রাজ্যের বিরোধীদের আন্তরিকতা তাঁদের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না (বরং আপনার দলের অনেককে সেই কঠিন সময়েও বিকৃত কথা বলতে শুনেছি)। আপনার পিসির হঠাৎ করে মনে হল, এটা দুর্ঘটনা নয়, চক্রান্ত। ব্যাস, তিনি একবার বললে যা হয় ! পুলিশ তো ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। একে তাকে জেরা করা শুরু হয়ে গেল। ড্রাইভার কোথায় চা খেয়েছে, অন্যকিছু মেশানো ছিল কিনা, ড্রাইভার ইচ্ছা করে ধাক্কা মেরেছে কিনা, কত প্রশ্ন উঠে গেল।
এ রাজ্যে স্বাভাবিক যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার রেওয়াজ প্রায় উঠেই যাচ্ছে। ড্রাইভার চক্রান্তে যুক্ত। সে নিজে মরে অন্যকে মারতে চায়। পাইলট চক্রান্তে যুক্ত। সে নিজে মরবে জেনেও বিমান ধ্বংস করতে চায়। প্রশাসনের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে এই সব আষাড়ে গপ্প কত অনায়াসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কেউ কোনও প্রতিবাদ করে না।
আচ্ছা অভিষেক, আপনিও কি মনে করেন ওই দুর্ঘটনা চক্রান্ত ছিল? দুধের গাড়ি কেন দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে জেরা করো। আরে বাবা, সে তো দাঁড়িয়ে ছিল। সে তো আপনার গাড়িকে বলেনি, পেছন থেকে এসে আমাকে ধাক্কা মারো। এখনও বিশ্বাস করি, সামনে পাইলট কার না থাকলে আপনার গাড়ি দুর্ঘটনার মুখে পড়ত না। পাইলট কার আচমকা বাঁক নেয়। আপনার গাড়ির ড্রাইভার সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে। এই তো সহজ একটা ব্যাপার। এটাকে অহেতুক জটিল কারা করছেন ? কী আশ্চর্য বিচার, দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির পেছন দিকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারল। অথচ, খুনের মামলা রুজু হয়ে গেল। আপনার গাড়ি গিয়ে ধাক্কা মারল, অথচ অন্যের নামে হয়ে গেল খুনের চেষ্টার মামলা। সরকারি আইনও পাল্টে গেল।
অভিষেক, এসব আপনার ভাল লাগছে ? রাজ্যের বাকি সাংসদদের ছেড়ে শুধু আপনাকে জেড প্লাস। দলের একজন সাংসদও ব্যাপারটাকে ভাল চোখে দেখছেন ? একজন সাধারণ সাংসদের বাইরে আপনি কে ? আপনার তো যুক্তি–বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়নি। আপনার মনে হয় না, শুধুমাত্র আপনার পিসির নাম মমতা ব্যানার্জি বলেই আপনাকে জেড প্লাস দেওয়া হচ্ছে ?
প্লিজ অভিষেক, তোয়াজ করা পুলিশরা আপনার পিসিকে খুশি করতে যা রিপোর্ট দিচ্ছেন, দিন। আপনি অন্তত স্বীকার করুন, ওটা দুর্ঘটনাই ছিল, খুনের চক্রান্ত ছিল না। যদি স্বীকার করতে না পারেন, অন্তত মনে মনে বিশ্বাস করুন। এবার পিসি–কে বলুন, আপনি সাধারণ সাংসদ হয়েই থাকতে চান। চারপাশে স্টেনগান ধারী নিরাপত্তার বলয় চান না। ফিরিয়ে দিন এই জেড প্লাস তকমা। তাহলে মনে হবে, নেতা হওয়ার অন্তত কিছুটা যোগ্যতা আপনার আছে। নইলে, আপনি চিরদিন ভাইপো হয়েই থেকে যাবেন।