কেজরিওয়ালকে খোলা চিঠি
সব্যসাচী কুণ্ডু
স্যার আপনার মেলের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। হ্যাঁ, এক সময় আমি আপনার অনুগামী ছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার হয়ে প্রচারও করেছিলাম। চাঁদাও দিয়েছিলাম। সেই সুবাদে হয়তো আপনাদের ওয়েব সাইটে নামটা ও ইমেল আইডি–টা এখনও রয়ে গিয়েছে। তাই আমার ইনবক্সে হঠাৎ আপনার চিঠি। না, আপনি শুধু আমাকে লিখেছেন, এটা ভাবার মতো মূর্খ আমি নই। যাঁদের ইমেল ছিল, হয়ত সবাইকেই পাঠিয়েছেন। উপরে শুধু আমার নামটা। যেন আমি মনে করি, শুধু আমাকেই লিখেছেন। কয়েকবছর আগে হলে আপ্লুত হতাম। দশজনকে গর্ব করে দেখাতাম। এখন আর দেখাতে ইচ্ছে করে না। জানি, ওপরে যতই আমার নামের সম্বোধন থাক, সেটা আসলে প্রোগ্রামিং করা। আসলে, এটাও জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মতোই।
যখন আন্না হাজারের হাত ধরে আপনার উদয় হোল, রাজনীতির আঙিনায় আপনার অভিষেক হল, তখন আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। আমার অনেক বন্ধু বান্ধবদেরও আপনার অনুগামী হওয়ার জন্য অনুরোধ রেছিলাম। আপনি সেদিন নতুন ভারত গড়ার ডাক দিয়েছিলেন, এক দুর্নীতি মুক্ত সমাজের কথা বলেছিলেন। একটু অন্যরকমভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। সত্যি বলপছি, তখন আপনার কথায় ভরসা করতে ইচ্ছে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আর দশটা রাজনীতির লোকের সঙ্গে আপনার কথাগুলো আলাদা। আপনি হয়ত ব্যতিক্রমী কিছু ছাপ রেখে যেতে পারবেন। তখন আমার মতো আরও অনেকে আপনার চোখে সেই সব অলীক স্বপ্ন দেখার অপরাধ করেছিল।
কিন্তু সত্যি বলতে কি সেই সব স্বপ্ন গুলো যে এত ঠুনকো হবে ভাবতেই পারিনি। সেদিন সোশ্যাল মিডিয়া আর সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে আপনার সংগ্রাম দেখেছিলাম। তারপর দীর্ঘ ছয় বছর পর সেই সংগ্রামী কেজরিওয়াল আর আজকের নেতা কেজরিওয়ালের মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাই না। সেদিনের সেই সংগ্রামী মানুষটাকে ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিতে দেখেছিলাম। ভারতবর্ষকে দুর্নীতি মুক্ত করতে মরণপণ লড়াই করার প্রতিজ্ঞা নিতে দেখেছিলাম। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে সেই মানুষটাই যখন ক্ষমতার লড়ায়ের খেলায় মেতে উঠতে দেখলাম, তখন হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারিনি।
২০১৫ সালে যখন একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসাবে দিল্লির মসনদে বসলেন তখন আপনার মুখ্য অ্যাজেন্ডা ছিল দিল্লিকে দুর্নীতিমুক্ত করা, নারী সুরক্ষায় জোর দেওয়া আর জন-লোকপাল বিল প্রতিষ্ঠা করা। দিল্লিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে করতে আপনি নিজেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। নারী সুরক্ষার বিষয়টা নিয়ে আর উচ্চবাচ্যও করলেন না। সাংবাদিকদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে শেষে একদিন বলতে শুনলাম যে, ‘নারী সুরক্ষা দিল্লি পুলিশের দেখা উচিত, দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রের আওতায়, তাই এই ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই।’ আর জন-লোকপাল বিল তো আজও বিশ বাঁও জলে। সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে সিনেমা দেখলেন, তার রিভিউ দিলেন। নিজের কাজকর্ম ছেড়ে মোদির গুষ্ঠি উদ্ধার করলেন। নির্বাচনী ইস্তাহারে যা যা বলেছিলেন তার কিছুই করে দেখাতে পারলেন না। সব দোষ চাপিয়ে দিলেন কেন্দ্রের ঘাড়ে আর মোদির ঘাড়ে। কেন্দ্র নাকি আপনাকে কাজ করতে দিচ্ছে না। এমনকী আপনার দুর্নীতি–মুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গিকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপনার দলের নেতারা যখন দুর্নীতিতে জড়িয়ে দলে দলে জেল যাত্রা শুরু করল, তখনও আপনি বলতে লাগলেন, ‘সব মোদির চক্রান্ত, মোদি আমাকে ভয় করে। মোদি পাগল, মোদি কাপুরুষ। তাই এই সব করছে।’ আস্তে আস্তে সমস্ত অ্যাজেন্ডা ভুলে আপনি মেতে উঠলেন মোদি বিরোধিতায়। তার জন্য কখনও লালু প্রসাদ যাদবের মতো নেতার সাথে কোলাকুলি করলেন, তো কখনও নারদ সারদার মতো দুর্নীতিতে জর্জরিত বাংলার নেত্রীর সাথে হাত মেলালেন। বলি মানুষকে কি বোকা পেয়েছেন? সদ্য অনুষ্ঠিত পাঞ্জাব আর গোয়ার বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগেই বলে দিলেন যে আপনার পার্টি নতুন ইতিহাস লিখতে চলেছে। সেখানে অমুক জাতের লোক মুখ্যমন্ত্রী হবে, অমুক জাতের লোক উপ-মুখ্যমন্ত্রী হবে। অমুক লোককে পনেরো দিনের মধ্যে জেলে পাঠাবেন! ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস দেখুন। আপনার লেখা ইতিহাসটা ভু-গোল হয়ে গেল। ভাবলাম, এবার হয়ত নিজেকে পাল্টাবেন। কিন্তু যখন ভোটে পরাজিত হওয়ার সব দোষ ইভি এম মেশিনের উপর চাপিয়ে দিলেন, তখন আপনার আর মায়াবতীর মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখতে পেলাম না। আপনি যে একজন আই আই টি–র প্রাক্তনী, সেটাও ভাবতে বেশ অবাক লাগল। তাই একসময়ের মহানায়ককে এখন জোকার ভাবতেও দ্বিধা-বোধ করি না। আপনাকে একটাই অনুরোধ করব! দয়া করে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ান, আত্মসমীক্ষা করুন।
যাই হোক, আসন্ন এম সি ডি নির্বাচনের জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে এখানেই শেষ করছি। ভাল থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। জয় হিন্দ।