স্বরূপ গোস্বামী
কেউ কেউ ইতাহাসের চাকাকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে ভালবাসেন। সভ্যতাকে কে কতটা পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে, এ যেন তার প্রতিযোগিতা।
একদিকে রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী। যেন দেশে আর কোনও সমস্যা নেই। একদিকে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্লোগান তোলা হচ্ছে, অন্যদিকে হনুমান জয়ন্তীও চলছে। আসল সমস্যার থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে সারা দেশে একটা অদ্ভুত বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, আমরাও দিব্যি মেতে আছি রাম আর হনুমান নিয়ে। সেই কত যুগ আগে একজন বলে ‘গিয়েছিলেন, ধর্ম হল আফিম।’ এ যে কী মারণ–নেশা, সেই লোকটার মৃত্যুর ১৩৪ বছর পরেও বোঝা যায়, লোকটা কতটা দূরদর্শী ছিলেন।
এ তো গেল বিজেপি–র কথা। বিরোধীরাও পিছিয়ে নেই। আমাদের রাজ্যের শাসকদল জমি ছাড়তে রাজি নয়। তারাও ঘটা করে হনুমান জয়ন্তী শুরু করে দিল। বুঝিয়ে দিল, ইফতারেও আছি, হনুমানেও আছি। বামেরা যে কী করবেন, এখনও বুঝে উঠতেই পারছেন না। যেদিকেই যাবেন, সেদিকেই সমালোচনা ধেয়ে আসবে। রামনবমীর পক্ষে বললেও মুশকিল। আবার বিপক্ষে বললেও সমালোচনা হজম করতে হবে। শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থায় তাঁরাও যেন দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না।
বিজেপি–র যদি বিরোধীতা করতে হয়, তাহলে সেরা উপায় হল তাদের উপেক্ষা করা। হনুমান জয়ন্তীকে যদি বেশি গুরুত্ব দিতে যান, তাহলে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। পাল্টা মিছিল করে কী বলবেন? যাই বলুন, মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। নানা অপ্রিয় প্রশ্ন ধেয়ে আসবে। যদি প্রশ্ন আসে, মহরমের মিছিলের সময় আপত্তি জানাননি কেন? কী উত্তর দেবেন? যদি প্রশ্ন আসে ফুরফুরা শরিফে কেন যান, কী উত্তর দেবেন? ধুলাগড় নিয়েও প্রশ্ন ধেয়ে আসতে পারে। গ্রহণযোগ্য উত্তর তৈরি আছে তো? সংখ্যালঘু উন্নয়নের থেকে তাদের তোল্লাই দেওয়ায় সবাই যেন বেশি ব্যস্ত। অতীতে বামেরাও তাই করেছেন, আজ তৃণমূল সেটা বাড়াবাড়ি জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই বিজেপি–র এই বাড়বাড়ন্ত।
সহজ কথা, বিজেপি–র বিরোধীতা করতে গেলে যে রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা দরকার, তা বিরোধীদের নেই। তাই পাল্টা মিছিল বা সমাবেশ করা মানে নিজেদের আরও হাস্যকর করে তোলা। তার থেকেও যেটা বড় বিপদ, তা হল বিজেপি–কে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলা। জেনে রাখুন, যে বই নিষিদ্ধ হয়, সেই বই পড়ার কৌতূহল সবসময় বেশি হয়। রামনবমী বা হনুমানের মিছিলে এখন যাঁরা ভিড় করছেন, তাঁরা কারা? একসময় তো এঁদেরই অনেকে বাম পার্টি অফিস আলো করে বসে থাকতেন। তাঁদের রাজনৈতিক চেতনা তৈরি করতে পারেননি কেন? এই আত্মসমালোচনা করবেন না? হনুমান মিছিলে এখন লোক হচ্ছে, যত গরম বাড়বে, লোক কমে যাবে। উৎসাহও কমে যাবে। কিন্তু যদি বাধা দিতে যান, এই উৎসাহ আরও বেড়ে যাবে। এই কঠিন সময়ে তাদের অক্সিজেন দেওয়া কি খুব জরুরি? যদি কেউ রাম নিয়ে থাকতে চায়, থাকুক। যদি কেউ হনুমান নিয়ে থাকতে চায়, থাকুক। আপনারা এই প্রশ্নটা বাদ দিয়ে অন্যান্য মৌলিক প্রশ্নগুলো তুলে ধরুন। এই বিষয়টাকে স্রেফ উপেক্ষা করুন। এই বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া মানেই হল তাদের পাতা ফাঁদে পা দেওয়া।
বিহারের নির্বাচনের কথা মনে করুন। সেখানে প্রশান্ত কিশোর লালু ও নীতিশকে একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন, বিজেপি যতই গরু গরু করে চিৎকার করুন, আপনারা ভুলেও ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটা উচ্চারণ করবেন না। ভুলেও ওদের পাতা ফাঁদে পা দেবেন না। লালু–নীতীশ দুজনেই শুনেছিলেন প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শ। ফলও পেয়েছিলেন।
বামেরা যদি সত্যিই সাম্প্রদায়িক প্রচারকে আটকাতে চান, তাহলে একটু চুপ করে থাকা প্র্যাকটিস করুন। সব ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানানো বন্ধ করুন। যত প্রতিক্রিয়া দেবেন, তত এই প্রবণতা বাড়বে। হনুমান ততই জীবন্ত হয়ে উঠবে। পাল্টা মিছিল বা বিবৃতি নয়, স্রেফ উপেক্ষাই এখন সেরা অস্ত্র।।