রক্তিম মিত্র
সিনেমা করে আপনি নাম করতে চান? এত সহজ নয়। ট্রেনে চড়ে কত ছেলে–মেয়ে যে একসময় বম্বে চলে যেত! কী জানি, এখনও হয়ত যায়। খেলাধূলা করে নাম করবেন? অনেক কঠোর সাধনা, অনেক অধ্যাবসায় লাগবে। তাও কেউ চিনবে কিনা কে জানে! গানবাজানা করে বা সাহিত্য করেও নিজেকে চেনানো কঠিন। আপনার মতো কত শিল্পী, কত কবি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গত সাতদিনের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, নাম করার সবচেয়ে সহজ উপায় হল কারও নামে ফতোয়া জারি করে দিন। কোনও বিখ্যাত লোকের মাথার দাম ঘোষণা করে দিন। সেইসঙ্গে একটু ধর্মীয় আবেগ জুড়ে দিন। ব্যাস, সবাই একদিনেই আপনাকে চিনে যাবে। কত অজানা বন্ধু পেয়ে যাবেন! মনে রাখবেন, বিকৃত জিনিসকে সমর্থন করার লোকের অভাব নেই।
গত সপ্তাহে আলিগড়ের এক অর্বাচীন মমতা ব্যানার্জির মাথার দাম ঘোষণা করল। গোটা দেশে হইচই, পার্লামেন্টে হইচই, টিভিতে আলোচনা, কাগজে প্রথম পাতায় হেডলাইন। এবার এই বাংলার আরেক ‘কৃতী’ সন্তান। তিনিও হয়ত সুযোগ খুঁজছিলেন। প্রেস ক্লাব ভাড়া নিলেন। মিডিয়া ডাকলেন। সোনু নিগমের পিন্ডি চটকালেন। দশ লাখের ফতোয়া জারি করে দিলেন। আবার গোটা দেশে হইচই। বেচারা সোনু। এই লোকটিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য মাথা ন্যাড়া করে নিলেন। একবার মনে হয়েছে, এই প্রতিবাদটা দরকার ছিল। আবার মনে হচ্ছে, লোকটাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কীই বা ছিল?
এই বাংলা থেকে এমন একটা হুমকি গেল। কই, তেমন প্রতিবাদ তো এল না। কয়েকদিন আগে যে ‘বুদ্ধিজীবী’রা নিন্দায় সোচ্চার হয়েছিলেন, আজ তাঁদের কণ্ঠগুলো বড় নীরব মনে হচ্ছে। একলাইনের ধিক্কার তো দেওয়া যায়। কলকাতা পুলিশ এতই সক্রিয় যে, যুব মোর্চার সেই ছোকরাকে ধরবে বলে আলিগড়ে সিআইডি–র দল পাঠানোর কথা ভাবছে। কিন্তু নাকের ডগায় প্রেস ক্লাবে বসে একজন হুঙ্কার ঝেড়ে বসল, তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। সোনু নিগমের বক্তব্যের সঙ্গে আপনি একমত না হতেই পারেন। সৎ সাহস থাকে তো মামলা করুন। তাই বলে এমন ফতোয়া জারি? এর নিন্দা না করলে আলিগড়ের ওই যুবককে ধিক্কার দেওয়াটা বড় একপেশে মনে হবে।
অপরাধ সবসময়ই অপরাধ। যেই করে থাকুক। ধর্মের নামে হুমকি দিলেই সাতখুন মাপ। এরা কোনও ধার্মিক নয়। এইসব লোক ধর্মের কিছুই বোঝে না। এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখুন, এদের কোনও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নেই। থাকতে পারে না। আমাদের নীরব প্রশ্রয় এই লোকগুলিকে ‘নেতা’ বানিয়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে আমরা সোচ্চার হতে পারি না বলেই অন্যরাও দ্বিগুন উৎসাহে পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে যায়। হনুমানের মিছিল বেরিয়ে যায়। কিছু হলেই ত্বহা সিদ্দিকি বা ইমাম বরকতিরা পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে বসেন। এক্ষেত্রে তাঁদের মতামতটা জানতে খুব ইচ্ছে করছে। আলিগড়ের সেই ছোকরা যখন মমতা ব্যানার্জিকে হুঙ্কার দিয়েছিল, হিন্দু সমাজ থেকেও কিন্তু ধিক্কার এসেছিল। এক্ষেত্রেও আবেদন, প্রগতিশীল মুসলিমরা এগিয়ে আসুন। নইলে, আপনাদের নীরবতা ভুল বার্তা ডেকে আনবে।
এবার অন্য একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দু চার কথা। কলকাতা প্রেস ক্লাব। এতদিনের ঐতিহ্যশালী একটা ক্লাবে বসে যে যা খুশি বলে দিতে পারে! হল ভাড়া নিলেই এমন উস্কানি দেওয়া যায়! এমন লোককে হল ভাড়া দেওয়া হয় কেন? হয়ত আগে থেকে জানা ছিল না। জানার পর কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? প্রেস ক্লাবের সদস্যরাই বা নীরব কেন? এই মঞ্চ ব্যবহার করে এমন নোঙরা উস্কানি দেওয়ার জন্য একটা ধিক্কার দেওয়া যেত না? ওই লোকটিকে আর কখনও প্রেস ক্লাবে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না? সাংবাদিকরা কী জন্য প্রেস ক্লাবে যান? শুধু সস্তায় মদ খেতে? ক্লাবের ঐতিহ্য যদি ফিরিয়ে আনতে হয়, ওই লোকটির নামে প্রথম এফআইআর–টি প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকেই করা হোক।