সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
নিউজ চ্যানেল বা সংবাদপত্রে চোখ বোলালেই দেখা যাচ্ছে “পদ্মাবত” সিনেমার মুক্তি এবং প্রদর্শন আটকাতে রাজপুত সেনা বা করণী সেনাদের উন্মত্ত তাণ্ডব। কোথাও সিনেমাহল ভাঙচুর করছে, কোথাও বা বাস-লরি পোড়াচ্ছে, আবার কোথাও রাস্তা বন্ধ করে পার্শ্ববর্তী দোকানপাটে আগুন লাগাচ্ছে। এমনকি স্কুলছাত্র বোঝাই বাসও এদের রোষানল থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। তার সঙ্গে ছবিটির পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানশালীকে মারণ হুমকি দেওয়া থেকে শুরু করে ছবির নায়িকা দীপিকা পাড়ুকোন এর নাক কাটার মতো মধ্যযুগীয় বর্বর শাসানি তো আছেই। এককথায় গোটা দেশের বেশকিছু রাজ্যে এই “পদ্মাবত” সিনেমার মুক্তিকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির সূত্রপাত।
“পদ্মাবত” সিনেমাটি মুক্তি পাওয়া উচিত কি অনুচিত তা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক চলতেই পারে, আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। প্রশ্ন হল দেশের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট যেখানে এই ছবিটির মুক্তির ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি এবং এও নির্দেশ দিয়েছে যে দেশের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেই এই সিনেমা মুক্তি পেতে পারে এবং এই ছবিকে কেন্দ্র করে কোনও অপ্রীতিকর অবস্থা বা হিংসার সূত্রপাত হলে সেই হিংসা রোধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যকেই সর্বোতোভাবে তা রোধ করতে হবে, সেখানে কী করে দেশের কয়েকটি রাজ্যে করণী সেনারা এই তাণ্ডব চালাতে সক্ষম হচ্ছে ? কেমন করে গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা বা মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্য থেকে গত ৪-৫ দিন ধরে প্রায়ই রাজপুত গোষ্ঠীর উন্মত্ততা এবং হিংসার ছবি দৃশ্যমান হচ্ছে ? তাহলে সেই রাজ্যগুলোর প্রশাসন কী করছে ? তারা কি হাত গুটিয়ে বসে আছে? না কি তারা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ জানে না? নাকি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ জেনেও “ইচ্ছাকৃত নিস্ক্রিয়” হয়ে রয়েছে উন্মত্ত করণী সেনার সামনে ? তারা কি এই অরাজকতা রুখতে অপারগ? নাকি করণী সেনাদের এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে তাদেরও প্রচ্ছন্ন মদত আছে বা সমর্থন আছে ?
ঘটনাচক্রে যে যে রাজ্যগুলো থেকে প্রতিদিনই এই হিংসাত্মক ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো বিজেপি শাসিত। তাই সন্দেহটা অন্যদিকে যায় বৈকি! এই বিজেপির প্রথমসারির নেতারা একসময় আমির খান অভিনীত “পিকে” ছবিটির মুক্তি আটকাতে কম চেষ্টা করেননি। বছরখানেক আগে মুক্তি পাওয়া “বাজীরাও মাস্তানি” নিয়েও তাদের ঘোরতর অসন্তোষ ছিল, একথা সবাই জানেন। সুতরাং তলে তলে করণী সেনাদের সঙ্গে বিজেপি বা তাদের নীতিগত পূর্বসূরী রাস্ট্রীয়স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-(RSS)এর গোপন আঁতাত থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। এমনকি করণীসেনাদের এইসব তাণ্ডবলীলার নেপথ্যে যে ওই রাজ়্যগুলোর শাসকদল বা কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদল বিজেপির পূর্ণ সমর্থন নেই তাই বা কে বলতে পারে জোর গলায় ?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনারা কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে তথাকথিত “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” চালানোর কথা সদম্ভে সারা ভারতে প্রচার করেছিলেন। তার সত্যতা নিয়ে যদিও সংশয় থেকেই যায়, তবুও আপনারা পারেন না এই উন্মত্ত করণী সেনার রোষানল থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে? দিন দুয়েক আগেই একটি স্কুল পড়ুয়াবোঝাই বাসে করণী সেনাদের আক্রমণ এবং অসহায় সেই শিশুগুলোর আর্তির সংবাদ প্রায় সব সাংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল। আপনারা পারেন না তাদের নিরাপত্তা দিতে? পারেন না, দেশের বিচারব্যবস্থার পীঠস্থান সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলার জন্য ওই রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রী ও প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করতে ? পারেন না, এই উদগ্র, উন্মত্ত বিভীষিকার বিরুদ্ধে আর একটা “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” চালাতে ? সমস্যাটা কীসের ? সদিচ্ছার ? না অন্যকিছুর ?