আমরা দর্শকরাই দায়ী।আমরা বিগতযৌবনা নায়িকাদের দেখলেই তাঁর খুঁত খুঁজে বার করি।ইস কি বুড়ি হয়ে গেছে বলি।না না এই বিশ্রী ছবি দেখবনা বলি।তাই হয়তো শ্রীদেবী তাঁর সাম্রাজ্য রক্ষা করতে গিয়ে শেষ হয়ে গেলেন। লিখেছেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।।
শ্রীদেবীর জীবনে কোনো ভরত মহারাজ আবির্ভূত হলে হয়তো বেঁচে যেতেন শ্রী।
যদি শ্রী কে তিনি বলতেন ‘মা গৃধঃ’ তাহলে হয়তো শ্রীদেবী রেহাই পেতেন এই যৌবন আটকে রাখার প্রতিযোগিতা থেকে।
‘মা গৃধঃ’ কথার অর্থ ‘লোভ করনা’।
পৃথিবীর সেরা অসামান্য সুন্দরী সুচিত্রা সেন।রূপগরবিণী তাকে বলেছেন অনেক সাংবাদিক কিন্তু সুচিত্রা সেনের জায়গায় নিজেদের বসালে মালুম হয় এই রূপ যৌবন গ্ল্যামার ধরে রাখা এবং অবসর নিয়েও সংবাদ শিরোনামে থাকা কত শক্ত।
এই যৌবন সরসী রূপ চলে যাওয়ার কি ট্রাজেডি ভয় সব পৃথিবীখ্যাত সুন্দরীদের গ্রাস করে।নেশার মতো চেপে বসে এই গ্ল্যামার দুনিয়ার কুহকিনী ডাক।
রূপ ক্ষয়িষ্ণু হলে এই গ্ল্যামার দুনিয়ার ক্যামেরার সব ফ্ল্যাশ তার উপর থেকে সরে যাবে হালের নায়িকাদের দিকে হয়তো এইটা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না।শ্রীদেবীও পারেননি।রূপ কি রানি তাঁর মুখে ঠোঁটে শরীরের নানা জায়গায় করিয়েছিলেন প্লাসিক সার্জারি।ওজন কমিয়ে রাখতেন ক্রাশ ডায়েটে।রোগা থাকতে,বলিরেখা ঢাকতে এতই চিন্তিত হয়ে পড়েন যে স্টেরয়েড নেওয়া শুরু করেন।বছরের অর্ধেক সময় বিদেশে কেটে যেত এই সার্জারির পর সার্জারি তার সাইডএফেক্টের কারনে।যা জানতনা তাঁর তামাম দর্শকরা।তারা তো সুন্দরী নায়িকা তাঁর গ্ল্যামারকেই ভালোবাসে।কজন দর্শক ভালোবাসে মানুষ নায়িকাদের কি নায়কদের?
মান্না দে-র গানের কথা ধরে বলতে হয় শালকিয়ার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সত্যি কথা লিখেছিলেন,
“শিল্পের জন্য শিল্পী শুধু
এছাড়া নেই যে তার অন্য জীবন।”
শ্রীও ভেবেছিলেন তাঁর দর্শক নায়িকার বলিরেখা মানবেনা তাকে হয়তো ছুড়ে ফেলে দেবে তাই চিরযৌবনা থাকবার ফন্দি আটলেন তিনি।কিন্তু ভগবান করে রেখেছিলেন আরও বড় ফন্দি।যার ফল আজ ঘটল।
ঝলমল করতেন শ্রীদেবী তাঁর প্রতিটি ফ্যাশন শোয়ে কিন্তু মুখ তাঁর থাকত করুন শুকিয়ে যাওয়া।কি এর কারন?
নায়িকা তো তাঁর রহস্যভেদ করবেনইনা করলেনওনা কিন্তু কোথাও যেন সবার মধ্যে থেকে একলা ছিলেন শ্রী।তিনি যেন শরীরে যৌবন ধরে রাখতে গিয়ে মন খারাপ নিয়ে চলছিলেন।
এই আকস্মিক প্রয়াণের কারন তিনি নিজেই নয়তো?
এত পারফেক্ট ফেস বডি রাখার খেলার নেশায় কি শ্রী নিজের মেয়েদের স্বামী পরিবারের থেকেও দূরে সরে যাচ্ছিলেন?
সিনেমাই তো পুরোটা জীবন নয়।
যৌবন তো একদিন যাবেই।কেউ যদি ভাবে চল্লিশ পঞ্চাশেও তাকে পঁচিশ দেখাবে তা কি করে হয়?সেই খেলাতেই মাতলেন শ্রীদেবী।
ওজন কমাতে কমাতে আর সার্জারির ভারে নিজেই শেষ হয়ে গেলেন।
যিনি শিশুবয়স থেকে অভিনয় জগতে লড়াই করে সেরা প্রথম সুপারস্টার বলি নায়িকা হন,
পদ্মশ্রীভূষিতা হন,ঘর সংসার পরিপূর্ন পান,মেয়েরাও মায়ের দেখানো পথে নায়িকা হবার দৌড়ে সামিল তখন জীবনে আর কি পাবার বাকি থাকে?
ক্যামব্যাক মুভি ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ ‘মম’ করে তাঁর মত বিশাল সাফল্য কোন যৌবন উর্ত্তীনা নায়িকা পাননি?
এরপরেও আরও আরও…থামতে কি জানতেন না তিনি?নাকি যৌবন ধরে রাখবার মোক্ষ?নাকি প্রতিযোগিতা?নাকি আরও নতুন চমক?
বিগতযৌবনেও বহু নায়িকা অনেক ভালো ছবি করেছেন।হ্যাঁ পুরুষশাসিত ইন্ডাস্ট্রিতে সেটা কম।তবু জীবনের বিনিময়ে যৌবন ধরে রাখার তাগিদে মৃত্যু কি বিকৃত মুখায়ব তো কোনো পারদর্শীতা নয়?একজন শিক্ষিতা নায়িকার এত হীনমন্যতা আত্মগ্লানি কেন?
অনেকেই ভাবেন সুচিত্রা সেন একাকী অন্তরালে জীবন কাটাতেন।কিন্তু তা নয়।কখন মোক্ষত্যাগ করতে হবে তিনি জানতেন।সুচিত্রা সিনেইতিহাসে একমাত্র নায়িকা যিনি অন্তরালে গিয়েও সংবাদ শিরোনামে থেকেছেন।যাকে নিয়ে বই আজও হটকেক, ট্যক অফ দ্য টাউন।
সুচিত্রারাও কি রূপ যায়নি?অনেক পরিবর্তন আসে তাঁর।কখনও ওভারমেকআপও করতেন।কিন্তু রিয়েল বিউটি নোমেকআপ লুকসে বেশী ভালো লাগত।কিন্তু যৌবন তো গেছেই তাঁরও।সুচিত্রা অন্তরালে গেলেও একাকিত্বে ভোগেননি।পরিবারের লোকদের ঘিরেই তিনি থাকতেন।
সুচিত্রা বলেছিলেন ‘সিনেমার পর্দায় আমি সুচিত্রা সেন ওটা ওখানেই শেষ করে এসছি।’
কিন্তু তিনি জানতেন তাঁর এই নিজেকে দর্শকের থেকে সরিয়ে নেওয়ার ফন্দি সব নায়িকার থেকে সুচিত্রা সেনকে আলাদা করে দেবে।’প্রণয় পাশা’ বক্সঅফিস সাফল্য না পাওয়ায় অসম্ভব ভেঙে পড়েন সুচিত্রা।তিনি ছুটে যান বেলুড় মঠে এবং ভরত মহারাজের কাছে অঝোর ধারায় কাঁদতেন তিনি।ভরত মহারাজ সুচিত্রাকে বলেছিলেন ‘মা গৃধঃ’।লোভ করনা। মা লোভ করনা। এই কথাই নিজের জীবনের মন্ত্র করে নেন সুচিত্রা।
প্রবল প্রতিকূলতা, নিঃসীম একাকিত্বের মধ্য দিয়ে তিনি তিমির অভিসারিণী।
তাঁর একমাত্র আলো শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ।কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্কে আটকে থাকেননি, আঁধার-অভিসারিকা, আলোক-সন্ধানী সুচিত্র সেন।
তখন তিনি প্রৌঢ়া, কিন্তু বাঙালির মনে তরুণীই হয়ে আছেন। কল্পনা কিংবা অবচেতনের গহন এলাকা ছাড়া আর কোথায়ই বা তাঁর দেখা পাওয়া সম্ভব?
তিনি রূপোলি পর্দার স্বপ্নসুন্দরী হয়ে থাকবেন।সুচিত্রা সেন কে পছন্দ করতেন শ্রীদেবী।তাই মিসেস সেনের প্রয়াণে শোকজ্ঞাপন করেছিলেন শ্রীদেবী।
শ্রী সেই লোভ কি ছাড়তে পারলেননা।
তাই যৌবন সরসী হয়ে থাকার প্রবল প্রচেষ্টা?
আকস্মিক মৃত্যুর শিকার হন, যারা আপাতদৃষ্টিতে তারা স্বাস্থ্যবান। পোস্টমর্টেমের পরেও এদের মধ্যে ৪ শতাংশের মৃত্যুর কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিছু ওষুধ থেকেও আকস্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে। যেমন বোটক্স। এই ওষুধ মুখের মাংসপেশির কোঁচকানো ভাব দূর করতে ব্যবহার করা হয়। বোটক্স ব্যবহার করলে বিশেষ করে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের মহিলাদের আকস্মিক মৃত্যু হওয়ার রিপোর্ট রয়েছে।শ্রীদেবী তার ঠোঁট স্তন সার্জারির মধ্যে দিয়ে যান।আরও গোপন গল্প হয়তো তিনি জানতেন।
সুচিত্রা সেন যেমন সরে যান দর্শকের চোখে তাঁর স্বপ্নসুন্দরী রুপ ধরে রেখে।আবার আম্রপালী সুপ্রিয়া দেবী যেমন ভঙ্গুর অস্থি নিয়ে ও তাঁর ক্লাস বজায় রেখেছিলেন।নুইয়ে গেছেন কুঁজো হয়ে সুপ্রিয়া তবু হারেননি।
কিন্তু শ্রীদেবী দুটোর কোনোটাই করলেননা।অনেকটাই এই পরিনতি হবার কারন সার্জারি বোটক্স স্টেরয়েড মেডিসিন।মাত্র চুয়ান্নতেই শেষকৃত্য।
শ্রীদেবী আমাদের কেই বা হতেন?তবু তাঁর প্রয়াণ মেনে নেওয়া যাচ্ছেনা।
এরজন্য আমরা দর্শকরাই দায়ী।আমরা বিগতযৌবনা নায়িকাদের দেখলেই তাঁর খুঁত খুঁজে বার করি।ইস কি বুড়ি হয়ে গেছে বলি।না না এই বিশ্রী ছবি দেখবনা বলি।তাই হয়তো শ্রীদেবী তাঁর সাম্রাজ্য রক্ষা করতে গিয়ে শেষ হয়ে গেলেন।
আজকাল অনেকেই অনেক পঞ্চাশ উর্দ্ধ্ব লোকরাও বিনা ডাক্তারি পরামর্শে জিম জয়েন করেন,হেভি ওয়েট তোলেন,কত মহিলাই বিউটি ট্রিটমেন্ট করান।যন্ত্রে ঢুকে ওয়েট লস করেন মেদ ঝরান।সাইজ জিরো ফ্যাশন ট্রেন্ড।এগুলো যে না জেনে করা কথা কতটা ক্ষতিকর যা স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করে।শুধু সুপারস্টার দের জীবনই নয় সাধারন মানুষও সুন্দর সেলফি তোলার তাগিদে এইসবের মধ্যে দিয়ে যান অলীক সুখে।
আমরা আমাদের নিজেদেরকে আর নিজের ভালো লাগায় সুস্থ থাকায় সাজাইনা।
কত লাইক কমেন্ট পাব অন্যলোক কি বলবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সাজাই।
যা আত্মমর্যাদাহানিকর।
আসুন আমরা মানুষ শিল্পীদের ভালোবাসি।তাঁরা আগে মানুষ তারপর স্টার।আমরা তাদের সবটাই ভালোবাসি শুধু রূপ যৌবনটুকু নয়।
যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন শ্রী।
শেষে তাঁর অভিনীত এই গানটাই মনে আসে,
‘Piya bin dil lage na ek pal ko man ma lage thes
Kaise jaaun main paraye des.’