সুশোভন পাত্র
লাহোর জেলে নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় ভগৎ সিং। বাইরে উত্তাল রাজনীতি, উদ্বিগ্ন গোটা দেশ। অথচ ভেতরে আশ্চর্য রকম ভাবলেশহীন ভগৎ সিং সেদিনও নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন পড়াশোনাতেই। বারান্দায় ভারী বুটের শব্দে পেয়াদা পরিবৃত জেলার এসে জিজ্ঞেস করলেন
– তোমার যদি কোন শেষ ইচ্ছে থাকে আমরা লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সহযোগিতায় সাধ্যমত তা পূর্ণ করবো।
হাতের বই’টার দিকে তাকিয়ে ভগৎ সিং বলেছিলেন,
– এই বইটা যেন আমি মৃত্যুর আগে পড়ে শেষ করে ফেলতে পারি। এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় জেলার তাকিয়ে দেখলেন বইটা। লাল মলাটে, কালো অক্ষরে লেখা, ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’। লেখক ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন ¹।
জনাব প্রধানমন্ত্রী, বলুন তো, ফাঁসির দড়িতে ঝুলেও আজ বেঁচে আছে কে? ব্রিটিশ সরকার না ভগৎ সিং? মানুষের ভালোবাসার মণিকোঠায় আজও বেঁচে আছে কে? ব্রিটিশ সরকার না ভগৎ সিং? শ্রদ্ধায়-স্মরণে আজও বেঁচে আছে কে? ব্রিটিশ সরকার না ভগৎ সিং? আর সেই ভগৎ সিং’র আদর্শেই বা বেঁচে আছে কে? রাশিয়ার জার না সোভিয়েতের লেনিন? খেজুরি-পিটার্সবুর্গ-কিয়েভ-গড়বেতা-বার্লিন-যাদবপুর-বেলোনিয়া; সভ্যতার বুকে বুল-ডোজার চালিয়ে মূর্তি না হয় ভেঙ্গেই দিলেন, কিন্তু তামাম দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের শোষণ মুক্তির ফিনিক্স স্বপ্নে বেঁচে আছে কে? রাশিয়ার জার না সোভিয়েতের লেনিন?
‘ব্রিক বাই ব্রিক’ সাজানো হয়েছিল বেলোনিয়ার লেনিন মূর্তি ধ্বংসের ‘ব্লু-প্রিন্ট’। উত্তর-পূর্বে সংগঠনের গুরু দায়িত্ব কাঁধে ২০১৪’তেই ত্রিপুরায় ঘাঁটি গাড়লেন আর.এস.এস’র প্রচারক সুনীল দেওধর। গত দু’বছরে ত্রিপুরায় আর.এস.এস’র শাখা বেড়েছে ৪৫০%। বুথ থেকে মহকুমা, জেলা থেকে রাজ্য; বিধানসভা নির্বাচনে সক্রিয় পঞ্চাশ হাজার আর.এস.এস সদস্য। প্রতিটি বিধানসভার দায়িত্বে একাধিক ‘বিস্তারক’। ৬০জন ভোটার পিছু একজন ‘পন্না প্রমুখ’। ছিল ‘ট্রেন স্বয়ং সেবক’ ² । ছিল তাঁবেদার মিডিয়া। ছিল গৃহপালিত রাজ্যপাল। ছিল ৫২ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সদম্ভ উপস্থিতি। ছিল প্রচুর অর্থ বল। ছিল রাষ্ট্র যন্ত্রের সাড়াশি আক্রমণ। ছিল ত্রিপুরা ভাগের ষড়যন্ত্র।
জনাব প্রধানমন্ত্রী, একটা মূর্তি, একটা ‘প্রান্তিক’ দল, একটা ‘বস্তাপচা’ আদর্শ, একটা পুঁচকে রাজ্য, আর দুটো লোকসভার আসন -তাতেই ত্রাহি ত্রাহি রব? তাহলে কি এখনও প্রাণ আছে চুরানব্বই বছর আগে মৃত লেনিনের মূর্তিতে ? জান আছে লেনিনের আদর্শে?
বের্টোল্ট ব্রেখট লিখেছিলেন-
“প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালির সান কার্লোর জেলে বন্দী ছিল কিছু সৈন্য, মাতাল আর চোর। সোশ্যালিস্ট এক সৈনিক কপিং পেন্সিল দিয়ে দেওয়ালে লিখলেন
– দীর্ঘজীবী হোক লেনিন।
ধূসর খুপরিতে আবছা, কিন্তু বিশাল হরফে লেখা কথাগুলো। জেলার দেখেই এক বালতি চুন সুদ্ধ পাঠালেন এক মিস্ত্রি। ছোটো একটা ব্রাশ দিয়ে সে চুনকাম করে দিল ওই ‘ভয়ংকর’ লেখা’র অক্ষর গুলির ওপরে। তাই এখন চুনেই আরও জ্বলজ্বল করছে লেখাটা
– দীর্ঘজীবী হোক লেনিন।
তারপর জেলার পাঠালেন আরেকজন কে, বড় একটা ব্রাশ নিয়ে। সে গোটা দেয়ালে বুলিয়ে দিল চুন। বেশ খানিকক্ষণ আর দেখা গেল না লেখাটা। কিন্তু সকালবেলা চুন শুকোতেই ফুটে উঠল লেখাটা
– দীর্ঘজীবী হোক লেনিন ।
রাগে অগ্নিশর্মা জেলার এবার পাঠালেন এক খোদাইকার। ঘন্টাখানেক খোদাই করলে সে। ছুরি দিয়ে কেটে-কেটে তুলে ফেলল একের পর এক অক্ষর। সবশেষে দেওয়ালে পড়ে রইল বর্ণহীন কিন্তু খোদাই করা লেখাটা
– দীর্ঘজীবী হোক লেনিন।
সব দেখেশুনে সেই সোশ্যালিস্ট সৈনিক তখন বললেন
– এবার তবে দেয়ালটাকেই ভাঙ্গ ³!
ভেঙেছিল দেওয়াল। মানুষের স্পন্দিত আন্দোলন, প্রতিরোধে ভেঙেছিল ফ্যাসিস্ট পার্টির বর্বরতার দেওয়াল। মুসোলিনির জায়গা হয়েছিল গ্যাস চেম্বারেই ⁴ । জনাব প্রধানমন্ত্রী, আস্ত মোডাস-অপারেন্ডি তে সওয়ার হয়ে না হয় ভেঙ্গেই দিলেন লেনিনের মূর্তি। কিন্তু ভাঙ্গা গেলো কি লেনিনের ভাবমূর্তি? ফিকে করা গেলো কি লাল ঝাণ্ডার রং ?
যে লাল ঝাণ্ডা আজও উড়ছে গোর্কির উপন্যাসে, আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রে, পিকাসোর চিত্রকলায়, পিট সিগারের গানে, নেরুদা কিম্বা জয়দেব বসুর কবিতায়। যে লাল ঝাণ্ডা আজও উড়ছে পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যবাদের গোলিয়াথ মার্কিন মুলুকের সাথে ভিয়েতনামের বুক চেতানো ডেভিডের লড়াইয়ে, তীব্র শৈত্য প্রবাহে দুর্বার পাহাড়ি পথে রেড-আর্মির লং মার্চে, পাভেল করচাগিনের চরিত্রের ‘ইস্পাত’ কাঠিন্যে। যে লাল ঝাণ্ডা আজও উড়ছে দুনিয়া কাঁপানো দশদিনের পেত্রোগ্রাদের জারের প্রাসাদে, রাইখস্ট্যাগের শিখরে, রাক্কার কিম্বা পিকিং’র আকাশে। যে লাল ঝাণ্ডা আজও উড়ছে , ঋষি প্রতিম হো চি মিনের আদর্শে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের রোমহর্ষক ইতিহাসে, ক্ষুদিরামের ফাঁসির দড়িতে, বিনয়-বাদল-দিনেশের আত্মত্যাগে কিম্বা সেলুলার জেলের দেওয়ালে।
লেনিনের মূর্তিটা ভাঙ্গতে বুল-ডোজারটা চালাচ্ছিল যে শ্রমিকটা, ভাঙ্গা মূর্তির মাথাটা দিয়ে ফুটবল খেলেছিল যে বেকারটা, ভাঙ্গা মূর্তিটা পৌরসভার গোডাউনে পৌঁছে দিল যে ভ্যান চালকটা, লেনিন মূর্তির ভাঙ্গার খবরে জান্তব উল্লাসে সোশ্যাল মিডিয়া তে ফেটে পড়েছিল যে অফিস ফেরতা চাকুরেটা, -আসলে এই ঘুণধরা আর্থিক ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা, ক্রূরতা জর্জরিত করছে তাঁদেরও। নীরব মোদী আর বিজয় মালিয়া পকেট কাটছে তাঁদেরও। পি.এফ সুদ কমলে, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি উঠলে, পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়লে; খেসারত দিতে হচ্ছে তাঁদেরও। জয় শাহ’র সম্পত্তি ষোল হাজার গুন বাড়লে রেশনে চিনিটা বাদ পড়ছে তাঁদেরও। এই পুঁজিবাদ ব্যবস্থার মরীচিকার অলীক স্বপ্নে প্রতিদিন, প্রতিপদে, প্রতিক্ষণে শ্রমের বঞ্চনার স্বীকার হতে হচ্ছে তাঁদেরও।
জনাব প্রধানমন্ত্রী, তাই আমরা জানি, শ্রমিকের নুন্যতম মজুরি আদায়ের লড়াইটা ঠিক যতটা আমাদের, ঠিক ততটাই তাঁদেরও। ‘সব পেটে ভাতের/ সব হাতে কাজের’ গগনভেদী শ্লোগানটা ঠিক যতটা আমাদের, ঠিক ততটাই তাঁদেরও। কৃষকের ফসলের ন্যায্য সহায়ক মূল্যের ইনকিলাবি মিছিলটা ঠিক যতটা আমাদের, ঠিক ততটাই তাঁদেরও।
আমরা জানি, আপনাদের প্ররোচনা আজ যারা লেনিন ভেঙ্গেছে নিঃসঙ্কোচে, একদিন নিজের হাতেই ঘরে ঘরে লেনিন গড়তে হবে তাঁদেরও। ধর্ম নয় পেটের খিদেই একদিন ঠিক লেনিন কে চিনিয়ে দেবে তাঁদেরও। যেদিন ‘প্রতি মাস হবে অক্টোবর, প্রতিদিন প্রত্যেকে লেনিন’, সেদিন ‘শ্রেণীশত্রু’ বেছে নিতে হবে তাঁদেরও। হিমোগ্লোবিনের হিল্লোল তুলে লাল নিশানের সব পাওয়ার মিছিলে মিশে যেতে হবে তাঁদেরও। শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার সংগ্রামের দীর্ঘ পথে আসলে তো ‘কমরেড’ সে, আমারও।