অজয় কুমার
আমার নাম গডসে ভূষণ ভৌমিক। আমাকে আপনারা চিনবেন না। কিন্তু নাম শুনে বুঝতে পারছেন। আমি একটি দলের একনিষ্ঠ সৈনিক। দল যদি বলে, আমি প্রাণ দিতে পারি। দল যদি বলে, আমি প্রাণ নিতেও পারি। দল যদি বলে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠাতে হবে, আমিও তাইই বলি। দল যদি নেপালি অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে চুপ করে থাকে, আমিও চুপ করেই থাকি। মোট কথা, দলের মতই আমার মত।
কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি দলের সঙ্গে একমত হতে পারছি না। আমাদের দলের সবাই জয় শ্রীরাম বলতে অজ্ঞান। বাঙালির ধর্মাচরণের সঙ্গে রামচন্দ্র, হনুমান ব্যাপারগুলো ঠিক খাপ খায় না। কিন্তু তাও বাঙালিকে রামচন্দ্র গেলানোর জন্য নেতারা উঠেপড়ে লেগেছেন। রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী এইসব করে প্রচার পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আসল কাজ, মানে ভোট পাওয়া যাচ্ছে কি? আমি নিজেও জয় শ্রীরাম জয় শ্রীরাম বলে নাচি। কিন্তু বেশ বুঝতে পারি, এতে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। কী করে হবে, তাও বুঝতে পারছি না।
অবশেষে বুঝেছি। আমাদের লাভ হবে কেষ্ট নাম জপ করে। এমনিতেই বাঙালির জীবনে রামের থেকে কৃষ্ণর গুরুত্ব বেশি। সাহিত্যই বলুন, গানই বলুন, কবিতাই বলুন, কৃষ্ণর ছড়াছড়ি। কিন্তু আমি সেই কৃষ্ণর কথা বলছি না। আমি বলছি কেষ্টর কথা। কেষ্ট কে, জানেন তো? নিশ্চয় জানেন। কিন্তু গুরুজনের নাম করতে নেই, তাই নামটা মুখে আনছেন না। আমিও মুখে আনছি না। কারণ, তিনি আক্ষরিক অর্থেই হেভিওয়েট নেতা। ওই ওয়েট নিয়ে যদি আমাকে ধাক্কাও দেন, আমার মাথায় অক্সিজেন কমে যাবে। কেষ্টকে নিয়ে এককালে আমরা কত বিদ্রুপ করেছি। কেষ্টর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার শপথ নিয়েছি। কিন্তু আজ বলছি, এই কেষ্টর মতো পরম সুহৃদ আমাদের আর নেই।
আমাদের নেতাদের কথায় কথায় রথযাত্রা বের করার ব্যামো আছে। কিন্তু রথ চালানোর মতো উপযুক্ত সারথী পাওয়া যায় না। আমাদের রাজ্যের নেতাগুলো একেকটি গবেট। একজন ত্রিপুরায় বসে বসে ডায়গল ঝাড়ছে। আরেকজন রাস্তায় নেমে তলোয়ার আর গদা ধরাচ্ছে। দুজন নেত্রী, তারা একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য কলতলার স্টাইলে ঝগড়া করছে। একজন রায়বাহাদুরকে অনেক ঢাকঢোল বাজিয়ে দলে আনা হল। সে কদিন বিশ্ববাংলা, বিশ্ববাংলা বলে চেঁচিয়ে নেতিয়ে পড়েছে। কারও কোনও জনভিত্তি নেই। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে পঞ্চাশটাও লোক হবে না। কিন্তু মহাভারতের যুগ থেকে স্বচ্ছ ভারতের যুগ, রথযাত্রায় সবথেকে ভাল সারথী হলেন কেষ্ট। এই কেষ্টই আমাদের রথকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়েছেন।
খাতায় কলমে কেষ্টবাবু আমাদের বিরোধী। বিরোধীই থাকুন। ওঁকে আমাদের দলে নিয়ে আসার কোনও দরকার নেই। ওঁর কাজে বাধা দেওয়ারও কোনও দরকার নেই। উনি করছেন, সেটা প্রাণভরে করতে দেওয়া হোক। দিদিমণির উন্নয়নকে খাটো করার জন্য আমাদের নেতারা কত চেষ্টা করেছে। কিন্তু উন্নয়নকে এভাবে ল্যাংটো করে রাস্তায় দাঁড় করাতে এইভাবে কেষ্টবাবু ছাড়া কেউ পারেনি। তলোয়ার, গদা, তীর ধনুক নিয়ে আমরা জনপ্রিয় হওয়ার কত চেষ্টা করেছি। সফল হইনি। কিন্তু কেষ্টার নারায়ণী সেনা যখন অস্ত্র হাতে ময়দানে নামল, অমনি আমাদের জনপ্রিয়তা চড়চড় করে বাড়তে লাগল। গ্রামে গ্রামে সদস্য বাড়ানোর জন্য আমরা কত চেষ্টা করলাম। এমন কিছু লাভ হল না। কিন্তু কেষ্টর চড়াম চড়াম ঢাকের আওয়াজ শুনে যে সাতে পাঁচে থাকে না, সেও আমাদের দিকে চলে এল। কারা যেন বলেছিল দিদির নাক কেটে সুর্পনখা করে দেবে। আরে ভাই, দিদির নাক–কান কাটার জন্য কেষ্টা একাই যথেষ্ট। অন্য কারও দরকারই হবে না।
এমনিতে সারা দেশে আমাদের হাল ঢিলে। সরব মোদি এবং নীরব মোদি, দুজনেই বেকায়দায়। দলিত, চাষা, উন্নাও, কাঠুয়া, কাবেরী, পদ্মাবতী সবাই আমাদের পেছনে লেগেছে। কী নিয়ে প্রচার করব, কী প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকের কাছে দাঁড়াব, বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কেষ্ট একাই সব প্রতিশ্রুতিকে অপিনিহিতি, অভিশ্রুতি বানিয়ে দিয়েছে। মানে, ব্যকরণের সব জটিল জিনিস কেউ যেমন মনে রাখতে চায় না, প্রতিশ্রুতি নিয়েও লোকে আর মাথাই ঘামাচ্ছে না। গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই স্কুলের বাঁদর বাচ্চাদের মতো স্ট্যান্ড আপ অন দি বেঞ্চ হয়ে গেছে। এখন আমাদের জিতলেও লাভ, হারলেও লাভ।
কেষ্ট ছাড়া কে করত আমাদের এতবড় উপকার! তাই রাম নয়, আজ থেকে আমি কেষ্ট–ভক্ত। কেষ্ট আমাদের গুড়বাতাসা, ক্যাপসুল যা খুশি খাওয়াক। মনেপ্রাণে জানি, কেষ্ট আমাদের দীনবন্ধু জগৎপতি। সংগঠনহীন, সদস্যহীন একটি দলকে সিংহাসন পাইয়ে দেওয়ার জন্য কেষ্ট একাই যথেষ্ট। ঠিক যেমন দাপর যুগে কৌরবদের কাঁচকলা দেখিয়ে পাণ্ডবদের সিংহাসন পাইয়ে দিয়েছিলেন। তাই আর রাম নয়, বাংলার আকাশ–বাতাস কেষ্ট নামেই মুখরিত হোক। যেখানে যত মোদিভক্তি আছেন, সমস্বরে বলুন, জয় শ্রীকেট, জয় শ্রীকেষ্ট।।