প্রকাশ্য রাস্তায় আপনার ছেলে বা মেয়ে বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের সঙ্গে আলিঙ্গনে বা চুম্বনে লিপ্ত। আর সেই ছবি বাংলার সবকটি সংবাদ মাধ্যমে বা নিউজ চ্যানেলে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে গেছে। আপনাদের “অতি আধুনিক এবং প্রতিবাদী সত্তা” তাকে সমর্থন জানাবে তো? দমদম মেট্রো কাণ্ডের পর এমন অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন তুলে ধরলেন সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি।।
খুব বেশি দিন নয় । বছর দশেক আগের কথা। আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরিতে জয়েনিং এর অপেক্ষা করছি। আর অবসর সময়ে টিউশনি করতাম। মনে পড়ছে, একটা ব্যাচ পড়াতাম এক ছাত্রীর বাড়িতে। সেই ব্যাচে দুটি মেয়ে পড়তো। তাদের বাড়িতে পড়াতে গিয়ে এটা বেশ বুঝেছিলাম, সেই ছাত্রীটির পরিবার খুবই আধুনিক, যাকে বলে Ultra-Modern . বিশেষ করে সেই ছাত্রীটির মা কে বেশ কয়েকবার রাস্তাঘাটে দেখেছিলাম জিনস পড়ে দোকান-বাজার করতে। এছাড়াও আরও অন্যান্য অত্যাধুনিক সংস্কৃতি দেখেছিলাম সেই ভদ্রমহিলার মধ্যে। তাঁর স্বামী, মানে মেয়েটির বাবাও যথেষ্টই আধুনিক ছিলেন। কিন্তু ভদ্রমহিলাকে দেখে এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে একটু বেশিই “আধুনিক” মনে হয়েছিল। এমনকি এটাও চোখে পড়েছিল, তাঁর চুলও আমেরিকা বা ইওরোপের মহিলাদের মতো “পুরুষের ধাঁচে” ছাঁটা। আমার মনে কোনওরকম সংস্কার কোনওদিনই ছিল না, তাই তাঁর মেয়েকে প্রাইভেট টিউশনি পড়ানোর সুবাদে তাঁর সান্নিধ্যে এসে বাঙালি নারীর এ হেন “পাশ্চাত্য সংস্কৃতি” দেখে বেশ ভালই লেগেছিল। কিন্তু যেটা আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছিল, তা হল,সময়ের অভাবে আমার একটি ছাত্রকে যখন অন্য একটি ব্যাচ থেকে সেই ব্যাচে নেওয়ার জন্য আমি ভদ্রমহিলাকে বলেছিলাম, তিনি সরাসরি আমাকে বলেছিলেন, তার মেয়ে যে ব্যাচে পড়বে, সেখানে তিনি কোনও ছাত্রকে একইসঙ্গে টিউশনি পড়তে দেবেন না। এর কারণটাও তিনি যা বলেছিলেন, তার মানেটা দাঁড়ায় এই যে, তিনি চান না, “ঘি আর আগুন” একসঙ্গে পাশাপাশি থাকুক কোনও টিউশনে। তাতে নাকি পড়াশোনা হবেই না বরং……
বিগত কয়েকদিন ধরে দমদম স্টেশনে এক যুগলের ওপর সহযাত্রীদের আক্রমণ এবং হেনস্থার প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়াতে উপচে পড়া প্রতিবাদ এবং “হোক আলিঙ্গন” নামে “প্রতিবাদের মাধ্যম” এবং তাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমর্থনের হিড়িক দেখে এই ঘটনাটার কথা মনে পড়ে গেল। আচ্ছা, যে পুরুষ বা মহিলারা আজকে “হোক আলিঙ্গনের” সমর্থনের সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় তুলছেন, তাঁরা তাদের নিজেদের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়েকে সেই প্রতিবাদে স্বেচ্ছায় সামিল হতে দেবেন তো ? ভাবুন তো একবার, প্রকাশ্য রাস্তায় আপনার ছেলে বা মেয়ে বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের সঙ্গে আলিঙ্গনে বা চুম্বনে লিপ্ত। আর সেই ছবি বাংলার সবকটি সংবাদ মাধ্যমে বা নিউজ চ্যানেলে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে গেছে—আপনাদের “অতি আধুনিক এবং প্রতিবাদী সত্তা” কি দু হাত তুলে নিজেদের ছেলে বা মেয়ে কে এই ঘটনাতে সমর্থন করতে পারবেন? নাকি নিজেদের ছেলে বা মেয়ে স্বেচ্ছায় এই “প্রতিবাদের ধরণে” সামিল হতে চাইলে সবার আগে তাকে বাধা দেবেন বা যেতে নিষেধ করবেন বা এই দাবি তোলায় তীব্র ভৎসর্না করবেন ? আপনাদের অজান্তে তারা “কলেজ যাচ্ছি বা টিউশনে পড়তে যাচ্ছি বা অফিস যাচ্ছি” বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই কাজে লিপ্ত হলে, সেটা জানার পরে সেই ছেলেটি বা মেয়েটি বাড়ি ফিরে আসার পরে তাকে চূড়ান্ত তিরষ্কার করবেন? বা লজ্জায় বাড়ি থেকে কয়েকদিন বেরোতে দ্বিধাবোধ করবেন ? আপনাদের “প্রতিবাদী সত্তা” কি তখন তথাকথিত ভারতীয় নারীর “সংস্কারাচ্ছন্ন অবগুণ্ঠনের” অন্তরালে আত্মগোপন করবে না ? নিজেদের ঔরসে বা গর্ভজাত সন্তান-সন্ততির বেলায় আপনারা কি সমাজ ও লোকলজ্জার কথা একশোবার ভাববেন না ?” পাঁচজনের পাঁচকথা” শোনার ভয়ে কি বেপরোয়া হতে পারবেন ?
উত্তর হচ্ছে, ‘না’। পারবেন না। পুত্রের বেলায় যদিওবা পারেন, কন্যার ক্ষেত্রে ৯৯% মা-বাবাই তাঁদের মেয়ের এই প্রতিবাদের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারবেন না। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি। এটাই ভারতীয় সমাজ-স্বীকৃত সংস্কার। আসলে আপনারাও আমার সেই ছাত্রীর মায়ের মতই বাহ্যিক প্রকাশে “আধুনিক” কিন্তু নিজেদের ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে মনে মনে তীব্র রক্ষণশীলতায় আচ্ছন্ন। অথচ আপনারাই অপরের ছেলে বা মেয়েকে মানে যেখানে প্রত্যক্ষভাবে লোকলজ্জার ভয় নেই, যেখানে সমালোচনার বাণে বিদ্ধ হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই, যেখানে আপনাদের “অভিভাবকত্ব” বা ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে না, সেখানে নিজেদের পুত্র-কন্যার বয়সী ছেলে মেয়েকে এই “অভিনব প্রতিবাদে” সামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছেন বা উৎসাহ যোগাচ্ছেন !
বস্তুতঃ এটাই বাস্তব। এটাই যদি প্রতিবাদের ধরণ হয়,তাহলে এই সমাজ আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। যেভাবে ভীড় মেট্রোতে সামান্য দায়িত্ববোধ প্রকাশ পাওয়ার “গুরু অপরাধে” এক যুবক ও যুবতীকে কিছু সংস্কারাচ্ছন্ন এবং বিকৃত রুচির সহযাত্রী চূড়ান্ত হেনস্থা এবং গায়ে হাত তোলার মতো বর্বরোচিত ঘটনা ঘটালো তার “প্রতিবাদ” অবশ্যই হোক। সেখানে দোষীরা সনাক্ত হলে তাদের উপযুক্ত আইনি-বিচার হোক। সকলে মিলে চলুন না এই দাবি করি, মেট্রোর প্রতিটি কামরাতে একজন করে পুলিশ মোতায়েন হোক পুরো যাত্রাটা পথটাতেই, যাতে কোও যাত্রীই কোনও কারণে এতটা “অসহিষ্ণু” না হতে পারে। প্রতিটি কামরায় এবং স্টেশন চত্বরে আগামী দিনে উপযুক্ত সিসিটিভি ব্যবস্থা থাকুক, যাতে সব ঘটনাই ধরা পড়ে কর্তৃপক্ষের চোখে। কিন্তু এই “হোক আলিঙ্গন” এর মতো পন্থায় কখনই নয়। তাতে সমাজের চোখে সেই যুবক এবং যুবতীর “প্রতিবাদী” সত্তার চেয়েও “ভোগবাদী” সত্তাটাই বেশি প্রকাশিত হবে বৈকি! কারণ এই সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষই ঘরে ও বাইরে “সমাজ” নামের বেষ্টনী দ্বারা পরিবৃত। চাইলেও তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না, সেই দুঃসাহস দেখাতে ক’জনে পারে ?
এবারে দেখা যাক,এই ঘটনার প্রভাব কতখানি। বিগত চারদিন ধরে যেভাবে এই ঘটনা “শান্তিপ্রিয়” বাঙালির নিস্তরঙ্গ জীবনে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে, তার ভয়ঙ্কর একটা বিষময় ফলাফল হল, সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্যত একটা প্রজন্মের চোখে আরেকটা প্রজন্ম “শ্রেণীশত্রু” হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রচার চলছে যে, বৃদ্ধ মানেই বর্তমানে সমাজ ও সংস্কৃতিতে অচল এবং বেমানান। জীবনের নানা ঘাত-অভিঘাতে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হলেও শুধু বৃদ্ধ হওয়ার অপরাধেই তিনি এই “অত্যাধুনিক সমাজব্যবস্থায়” একেবারেই “অযোগ্য”। এই বিষ ছড়ানো চলতে থাকলে, এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে “প্রবীণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ” মানুষ তরুণ প্রজন্মের কাছে হেনস্থা এবং আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বাসে-ট্রেনে চড়তে ভয় পাবেন, বাড়ি থেকে বেরোতেই ভরসা করবেন না। মুষ্টিমেয় কিছু বিকৃত রুচির মানুষের জন্য একটা গোটা প্রজন্মকেই ভুগতে হবে। সেটা হবে এই “পঙ্গু সমাজব্যবস্থার” আরও নগ্ন রূপ।
সবশেষে এটাই লিখবো, একটা “স্বর্গীয় সম্পর্ককে” মর্যাদা দেওয়ার মতো মানসিকতা যে কোনও দুটি যুবক আর যুবতীরই থাকা উচিত। সেই সম্পর্কে গভীরতা থাকলে তা প্রকাশ্যে জনসাধারণকে প্রদর্শন করার মতো মনোবৃত্তি আদপেই সেই গভীরতাকে অনেক লঘু করে দেয়, তাকে “খেলো” করে দেয় জনসাধারণের চোখে। কারণ প্রেমের স্বভাবই হল অন্তর্মুখী। যে প্রেমে গভীরতা থাকে, তা জনসমক্ষে উদ্ভাসিত করার দরকার পড়ে না, বরং তা ঝোড়ো বাতাসের মতই চোখে না দেখেও অনুভব করা যায়।