ভোটকর্মীর ডায়েরি
স্নেহাংশু চৌধুরি
বেঙ্গল টাইমসে ভোটকর্মীর ডায়েরি বিভাগটি বেশ উপভোগ্য। বেশ কয়েকটি কিস্তি পড়লাম। ভোটকর্মীদের চোখ দিয়েই বোঝা যাবে, ভোটের নামে ঠিক কী কী হয়েছে। প্রায় সব জেলায় একইরকম ছবি। তাঁরাই কাছ থেকে দেখেছেন ভোটের চালচিত্র। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের সেই আবহে কাটাতে হয়েছে। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় ছাপ্পায় সহযোগিতা করেছেন। কেউ কেউ নিতান্তই অনিচ্ছায় করতে বাধ্য হয়েছেন।
আমি উত্তরবঙ্গের কোনও এক জেলায় শিক্ষকতা করি। স্বাভাবিকভাবেই ভোটের ডিউটি পড়েছিল। আগে থেকেই আন্দাজ করছিলাম, কী রকম ভোট হতে পারে। তাই যাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। বাড়ির লোকেরও আপত্তি ছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে! যেতে হয়েছিল।
অন্যান্যবার অন্তত সেক্টর অফিসাররা মুখে বলেন, যে কোনও সমস্যা হলে ফোন করবেন, এস এম এস করবেন। এবার যেন তাঁরাই সবথেকে বড় এজেন্ট। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখলাম, অন্যান্য সহকর্মীর অভিজ্ঞতাও মোটামুটি একইরকম। অপারেশনটা বোধ হয় শুরু হয়েছিল একেবারে ওপর থেকে।
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সেক্টর অফিসাররা কিনা বলছেন, বেলা এগারোটার মধ্যে ভোট কমপ্লিট করে ফেলবেন। কেউ বেশি বিপ্লব দেখাতে যাবেন না। যা চলবে, তাই চলতে দেবেন। বিপদে পড়লে কেউ আপনাকে বাঁচাবে না। আমিও না। প্রশাসনও না। নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই দেখতে হবে। এমন কিছু করবেন না যাতে নিরাপত্তা বিপন্ন হয়।
নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঠিক শুনছি তো? প্রথমে ভেবেছিলাম, আমাদের সেক্টর অফিসার বোধ হয় একটু তৃণমূলপন্থী। তাই অতিরিক্ত উৎসাহে এমনটা বলছেন। পরে অন্যান্য বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিলাম। অনেকেরই অভিজ্ঞতা একইরকম। চাপটা এসেছে একেবারে সেক্টর অফিসারের কাছ থেকেই। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, ভোট কোন খাতে বইতে চলেছে।
এলাকায় গিয়ে অবশ্য তেমন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। একজন তৃণমূন নেতা এসে বলে গেলেন, আপনাদের কোনও সমস্যা নেই। কেউ গায়ে হাত দেবে না। আপনারা শুধু একটু কোঅপারেট করবেন। সারাদিন ভোট হোক। দুপুরদিকটায় এমনিতেই লোক থাকবে না। ওই সময়টায় এক ঘণ্টা একটু আমাদের ছেলেদের ছেড়ে দেবেন।
আমাদের মধ্যে একজন বলল, হিসেব মিলবে না তো। তখন তো আমরা বিপদে পড়ব।
সেই নেতা আশ্বস্ত করলেন, কোনও চিন্তা নেই। হিসেব মেলানোর দায়িত্ব আমাদের। যারা যারা দিতে আসবে না, আমরা লক্ষ রাখছি। শুধু সেই ভোট গুলোই পড়বে। অনেকেই বাইরে থাকে। তাদের অনেকেই আসেনি। তাছাড়াও অনেকে আসবে না। কেন আসবে না, সেটা আপনাদের ভেবে কাজ নেই। আমরা সেইগুলোই দেব। চিন্তা নেই, হিসাব ঠিক মিলে যাবে।
তেমন ঝামেলা অবশ্য হয়নি। কী জাদুতে, জানি না, গ্রামের অধিকাংশ ভোটার ভোট দিতেই আসেনি। হয়ত রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়েছিল। এক দেড় ঘণ্টা স্থানীয় সমাজসেবীরা সেই মহান কাজটি করলেন। আমরা তখন দুপুরের খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। কী ঘটেছে, তার সাক্ষী থাকতে হল না। নিজেকে ব্যর্থ সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা, যাক আমার সামনে তো ঘটেনি!
(ভোটকর্মীর অভিজ্ঞতা। লেখকের চাকরির নিরাপত্তার স্বার্থেই সঠিক নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হল। তাঁর বেছে দেওয়া নামই ব্যবহার করা হল। নামগুলি কাল্পনিক হলেও ঘটনাগুলি কাল্পনিক নয়। চেনা–জানা ভোটকর্মীদের কাছে খোঁজ নিলেই বুঝতে পারবেন। আপনিও আপনার অভিজ্ঞতার কথা লিখে জানাতে পারেন। আপনি চাইলে, আপনার সঠিক নাম গোপন রাখা হবে। )