রবি কর
বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। বাংলাকে, বাংলার মানুষকে, বাঙালির প্রতিভাকে দমিয়ে রাখার যে অপচেষ্টা বছরের পর বছর ধরে দিল্লির শাসকরা করে আসছে, সেই ষড়যন্ত্রের জাল আজ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
নইলে বাংলার ইতিহাসের চিরশ্রেষ্ঠ প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে এত কার্পণ্য কেন? নিজের ঢাক নিজে না পেটালে কি এই জগতে সম্মান পাওয়া যাবে না ? দুর্জনে বলে, নোবেল পুরস্কার পেতে গেলে অনেক লবি করতে হয়। রবীন্দ্রনাথও নাকি বিলেতে গিয়ে নিজের বইয়ের প্রচার করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীযুগের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা, ইতিহাসের বিচারে রবীন্দ্রথকেও ছাপিয়ে যাওয়ার সব উপকরণ যার মধ্যে আছে, তিনি অর্থাৎ আমাদের দিদি কেন নোবেল পাচ্ছেন না? তিনি প্রচারবিমুখ, এটাই কি তাঁর অপরাধ? এই বঞ্চনার দায় কার?
দায় আমাদের সকলের। দিল্লির শাসকরা, যারা চিরকাল বাংলার সঙ্গে বিমাতৃসুলভ ব্যবহার করে এসেছে, তাঁরা দায়ী তো বটেই, কিন্তু তার থেকেও বেশি দায়ী আমরা, বাঙালিরা। আমরাই দিদির প্রতিভাকে সঠিকভাবে, সঠিক জায়গায় তুলে ধরতে পারিনি। আর এ ব্যাপারে সমগ্র বাঙালির জাতির মধ্যে যিনি প্রধান দোষী তিনি হলেন, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অকর্মণ্যতা, গয়ংগচ্ছভাব এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অভাবের ফলে বাঙালি জাতি অপরিমেয় ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে।
বুঝতে পারছেন না ? তাহলে, একটু বুঝিয়ে বলি। সেদিন ছাত্রছাত্রীদের সংবর্ধনায় দিদিমণি তাদের হাতে নিজের লেখা কথাঞ্জলি বইটা তুলে দিলেন। বললেন, “এই বই থেকে ছাত্রছাত্রীরা জীবনে cool থাকার প্রেরণা পাবে।“ কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, প্রেরণা পাবার অধিকার কি শুধু ছাত্রছাত্রীদের? আজকের এই অশান্ত সময়ে, মানবতা যখন বিপন্ন, তখন সমগ্র মানব জাতিরই প্রেরণা প্রয়োজন। দিদি ছাড়া আর কে আছেন প্রেরণা দেবেন ? প্রেরণা পাবার জন্য কথাঞ্জলির মতো বই আর কোথায় পাওয়া যাবে ? তাই বিশ্বের তথা মানবজাতির উন্নতির স্বার্থে কথাঞ্জলির রচয়িতাকে কেন নোবেল দেওয়া হবে না?
সাহিত্যপ্রেমীরা বলেন, তারাশঙ্কর-বিভুতিভূষণ-মানিক নোবেল পাননি এটা বাংলা ভাষার দুর্ভাগ্য। এই দুর্ভাগ্যের শিকার আমরা আর কতবার হব ? না, নতুন করে দুর্ভাগ্যের শিকার হতে আমরা চাই না। উপরোক্ত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে শতগুণ বেশি প্রতিভা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনায় নতুন যে বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন, নোবেল তাঁকে দিতেই হবে। শুধু সাহিত্যে নয়, বিশ্বশান্তিতেও। এটা আমাদের প্রার্থনা নয়, আমাদের দাবি। নইলে, আমরা ভাঙচুর, শান্তির দাবিতে অশান্তি, সব করতে পারি । আমরা বজ্রনির্ঘোষে জানতে চাই, ‘কথাঞ্জলি-ক্রোকোডাইল আইল্যান্ড-অশুভ সংকেত-উপলব্ধি-এক পলকে এক ঝলকে-নন্দীমা’ প্রভৃতি কালজয়ী বই লেখার পরেও কেন, বুকার কমিটি, পুলিতজার কমিটি, ম্যাগসেসে কমিটির বিবেচনায় আমাদের নেত্রীর নাম আসবে না? এর পিছনে কি শুধুই দিল্লির শাসকদের চক্রান্ত আছে ? নাকি বামপন্থীদের মদতপুষ্ট কোনও আন্তর্জাতিক শক্তি বাঙালির বিশ্বজয়ের গতিকে অবরুদ্ধ করতে চায়?
শুধু আন্তর্জাতিক স্তরেই নয়, আমাদের নিজের দেশে এই চক্রান্তের জাল কতদূর ছড়িয়েছে তাঁর প্রমাণ সাহিত্য আকাদেমি, জ্ঞানপীঠ প্রভৃতি পুরস্কারের জন্য নেত্রীর নাম বিবেচিত না হওয়া। আনন্দ পুরস্কারের কথা বাদই দিন, মা-মাটি-মানুষের শত্রু আনন্দবাজার গোষ্ঠী কোনও দিনই দিদিকে এই পুরস্কার দেবে না। দিলে আমরাও গাইতে পারতাম, ‘আহা কী আনন্দ ঘাসেতে, ফুলেতে।’ হায়! যিনি নোবেল পাবার যোগ্যতা রাখেন, তাঁকে আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে না, এটা দিদির লজ্জা নয়, আনন্দ পুরস্কারের লজ্জা। আকাদেমি পুরস্কারের-র লজ্জা, জ্ঞানপীঠ পুরস্কারের লজ্জা।
তাই উদ্যোগটা আমাদেরই নিতে হবে । মানে বাংলার মা-মাটি-মানুষকেই নিতে হবে। আমাদের দাবি, অবিলম্বে রাজ্য সরকারের তরফে দিদিকে রবীন্দ্র পুরস্কার এবং বঙ্কিম পুরস্কার দেওয়া হোক। আমরা জানি, আমাদের দিদি তো আত্মপ্রচার একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি এর বিরোধিতা করবেন। কিন্তু আমরা এও জানি, এই পুরস্কার পেলে তিনি যারপরনাই খুশি হবেন (খুশি হলে সপ্তাহে সপ্তাহে বই লিখবেন। বাংলা প্রকাশনা শিল্প নতু দিশা পাবে। বাংলাও কিছুটা পরিত্নান পাবে)। যিনি প্রথম এই পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব তুলবেন, তাঁর পদোন্নতি কে ঠেকায়!
আর ঠিক এখানেই পার্থবাবুর ব্যর্থতা। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার কাজে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। পুরস্কার দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর হাতে নেই, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে যে ক্ষমতা তাঁর হাতে আছে, তা পুরস্কারের থেকে কম নয়। সেই ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারলে আজ তিনি……। কিন্তু সে বুদ্ধি তাঁর থাকলে তো। আচ্ছা আপনারাই বলুন, কথাঞ্জলি বইটা কাদের দেওয়া হল ? মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট- সেকেন্ড হওয়া ছেলেমেয়েদের। আচ্ছা, যারা পড়াশোনায় ভালো, দিদির বই থেকে প্রেরণা কি শুধু তারাই পাবে ? আমার আপনার মতো গাড্ডু খাওয়া ছাত্রদের কি প্রেরনার প্রয়োজন নেই ? দিদির বাণীকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার কি প্রয়োজন নেই?
হ্যাঁ প্রয়োজন আছে। তাই শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবুর উচিত দিদির লেখা কবিতাগুলোকে মাধ্যমিকের সিলেবাসে ঢোকানো। কিন্তু এব্যাপারে তাঁর কোনও উদ্যোগই নেই। অথচ দিদি তো তাঁর সামনেই ছাত্রছাত্রীদের কথাঞ্জলি উপহার দিয়েছেন । তাঁর সামনেই এই বই থেকে প্রেরণা নিতে বলেছেন। দিদির প্রতি এই অবিচারের জন্য, আগামি প্রজন্মের প্রতি এই অবিচারের জন্য জাতি আপনাকে কখনও মাফ করবে না। আচ্ছা পার্থবাবু, আপনি নিজে কখনও দিদির কবিতাগুলো পড়েছেন ? আমাদের ধারনা, পড়েননি। পড়লে এভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারতেন না। কীসের ভয় পাচ্ছেন বলুন তো ! আইনের ? সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সরকারি বিজ্ঞাপনে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ছাপা চলবে না। সরকারি সিলেবাসে মুখ্যমন্ত্রীর কবিতা থাকা চলবে না, এমন তো বলেনি। তাহলে খামোখা ভয় পাচ্ছেন কেন ? নিন্দুকেরা কে কী বলবে ? নিন্দুক সব যুগেই থাকে। এমন মহান প্রতিভাদের সমকাল কবে আর বুঝেছে ? গ্যালিলিও, আইনস্টাইন ,অ্যারিস্টটল থেকে আমাদের দেশের রামমোহন, বিদ্যাসাগর – সবার নামেই কুৎসা ছিল। দিদির কবিতা সমকালের গন্ডি ডিঙিয়ে মহাকালের জন্য।
‘কবিতা’ নামক বইয়ের ‘আমার গহীন জলের নদী’ কবিতাটির একটি অংশ পড়ুন,
ভরদুপুরে মেজাজটা যেন খাট্টা
কাঁচালঙ্কায় চোখগুলো সব লাল
চায়ের পাতায় নিম পাতারই সুর
ভাত ঘুমগুলো একেবারে কর্পূর।
… আহা শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
তারপর ধরুন, ‘নেতাই’ কাব্যগ্রন্থের ‘তথাস্তু’ কবিতাটি,
“সূর্যমুখী ফুলগুলো ল্যাজ তুলে নাচছে
ঝিঁঝি পোকার ঘ্যানঘ্যানানি আলোতে
দূর থেকে ভেসে আসে ঘণ্টা
আওয়াজটা কি মিষ্টি
ছন্দটাও আহ্বানের
তবে কি নূতন আসছে?
মহর্ষি বাল্মীকি রামনাম জপছে-
পাপের পাপাচারে পেঁপেও তেতো
প্রতিকারে প্রতিপক্ষ ল্যাংড়া
ডুগডুগির চামড়াটা গেলো ফেটে
ধুতির কোঁচাটাকে কেঁচোতে ধরেছে
কিচির-মিচির বসন্তের কোকিল
কুহু- কুহু- আহা-আহা”
আহা! আহা! মধু! মধু! একটা ইংরাজি কবিতা শুনবেন? Melody of Vina কবিতার শেষ চার লাইন।
Methinks, I am alive
Are you alive?
This then life’s motto shall be
The tune- Life’s instrument will be.
কোথায় লাগে সেক্সপিয়ার!
অঞ্জলি শব্দটির প্রতি দিদির একটু মোহ আছে। কথাঞ্জলি বইতে,
“জীবন- জীবনী- জীবন প্রন্থে জীবন জীবনাঞ্জলি
শতক চলে আবার আসে নতুন শতাঞ্জলি”- এটা তো এত দিনে প্রবাদের রূপ ধারন করেছে। কিন্তু আফ্রিকা কবিতাতেও তিনি লিখেছেন,
“অনেক রক্তে যুদ্ধাঞ্জলি
যুদ্ধের হোক বিরতি”
যুদ্ধাঞ্জলি অর্থাৎ যুদ্ধের অঞ্জলি। ভাবুন, কি ভাষা! কি ভাব! কি অনুপ্রাস! যেন বৈদ্যনাথের চ্যবনপ্রাস! নতুন বইয়ের নামটা একবার ভাবুন। কথামৃত থেকে কথা। আর গীতাঞ্জলির ‘ঞ্জলি’। রামকৃষ্ণ আর রবীন্দ্রনাথকে এভাবে কেউ কখনও মেলাতে পেরেছেন ? শান্তি আর সাহিত্যের যৌথ নোবেল দিলে একটা নতুন রেকর্ড তৈরি হবে। তিনিই প্রথম শান্তির দূত, যিনি সাহিত্যে নোবেল পাবেন। বা বলতে পারেন, তিনিই প্রথম সাহিত্যিক, যিনি শান্তির জন্য নোবেল পেতে পারেন। পাহাড় হাসছে, জঙ্গল হাসছে, মুচকি নয়, প্রকাশ্যেই হাসছে। ওই মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীরাও হাসছে। নোবেল-বাবুরা দেখতে পাচ্ছে না !
ওরা না হয় নির্বোধ। ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি দেখে ভেবেছিলাম, ফ্রেঞ্চদের মতো আপনি হয়ত শিল্প, সাহিত্যের কদর করতে জানেন। এখন দেখছি, শুধু পেট নয়, মাথাটাও বেশ মোটা। এমন কবির কবিতা কেন সিলেবাসে থাককবে না? পার্থবাবু অবিলম্বে উদ্যোগী হন। দিদি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, রেলের রং থেকে স্টেশনের নাম সবই তিনি একা করতেন। কিন্তু শিক্ষার জন্য তো আপনার মতো একজন আলাদা মন্ত্রী আছেন। দিদিকে কি সব কিছুই মুখ ফুটে বলতে হবে ? ভেবে দেখলাম, একটা দুটো কবিতা ঢোকালে ব্যাপারটা বড় হালকা হয়ে যাবে। পুরো কথাঞ্জলিটাকেই সিলেবাসে রাখা যায় না ? রবি ঠাকুরের সহজ পাঠ যদি থাকতে পারে, তাহলে দিদিমণির কথাঞ্জলি থাকতে দোষ কী ? আরও একটা কথা, এটা শুধু একটা ক্লাসে রাখলে চলবে না। সবার জীবনে প্রেরণা দরকার। সবার ‘কুল’ থাকা দরকার। তাই ফাইভ থেকে টুয়েলভ, সব ক্লাসেই থাকুক না, ক্ষতি কী ? দরকার হলে এস এস সি, পি এস সি এসব পরীক্ষাতেও কথাঞ্জলি থেকে প্রশ্ন আসুক।
ইতিহাসের সিলেবাসও ঢেলে সাজান। সেই সিলেবাসে সিধো- কানহুর পাশাপাশি ডহরবাবুর কৃতিত্বও সমান গুরুত্ব পাক। বাংলার বিধানসভায় রামমোহনের অবদান, গান্ধিজির অনশন ভঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা এসব অজানা ইতিহাস স্থান পাক সেই সিলেবাসে।
ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস পরিবর্তিত হোক। বর্তমান সিলেবাসে বলা আছে সেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) এলিজাবেথান যুগের কবি। কিটস ( ১৭৯৫-১৮২১) রোম্যান্টিক যুগের কবি। আর রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) আধুনিক যুগের কবি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিলেতে গিয়ে কিটস এবং সেক্সপিয়ারের সাথে কী কী আলোচনা করতেন তা এই সিলেবাসে বলা নেই। নতুন সিলেবাসে এব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণ থাকুক।
তাড়াতাড়ি করুন পার্থবাবু, তাড়াতাড়ি করুন। ভোট এসে গেলে তখন নির্বাচনী বিধির আওতায় পড়ে যাবেন। সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। বাঙালি জাতি আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দিদির কবিতাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতেই হবে। নইলে আপনার ম্যানেজমেন্ট পড়া বৃথা, ডক্টরেট করা বৃথা।
হ্যাঁ জানি, নিন্দুকেরা অনেকে দিদির কবিতাগুলো নিয়ে হাসাহাসি করে। কিন্তু কবি জয় গোস্বামী, অধ্যাপক ব্রাত্য বসু তো হাসেন না। একাধারে বাংলা কবি এবং ইংরিজির অধ্যাপক সুবোধ সরকার তো হাসেন না। ওঁদের চেয়েও বিখ্যাত, সেলিব্রিটি শিক্ষক বিজন সরকার তো হাসেন না। ওরা কেউ যদি আপনার আগে সিলেবাসে দিদির কবিতা ঢোকানোর প্রস্তাবটা দিয়ে দেন, আর দিদি যদি আপনার বদলে তাদের কাউকে শিক্ষামন্ত্রী করে দেন, তখন কি ভালো হবে ? একসময়ের নম্বর টু, এক ফ্রেঞ্চ কাট-বাবুর কী দশা হয়েছে দেখেছেন তো। নিজের ভাল তো পাগলেও বোঝে, আপনি বোঝেন না!